ঐতিহ্যের
ইতিহাসপর্বঃ
আজ ইতিহাসপর্বে বিল্বপত্তন
গ্রামের বড়কালী ইতিহাস।
রচনায় শ্রীমান্ শঙ্খ।
বিল্বপত্তন(বড়বেলুন) গ্রামের বড়কালী। পূর্ব
বর্ধমান।
বঙ্গভূমি
সততই মতৃভূমি। পলিমাটির
নরম আদলে গড়ে এখানকার
মানসিকতায় শক্তিদাত্রী জগন্মাতার আবির্ভাব ঘটেছে বারংবার, পরম
করুণাময়ী রূপে, পরম স্নেহময়ীরূপে। মন্ত্রতন্ত্রের
রাজসিক ঐশ্বর্য্য দিয়ে দেবীকে তুষ্ট
করতে হয়নি বরং সাত্ত্বিক
ভক্তির সম্পদেই দয়াময়ী ধরা দিয়েছেন
ভক্তের কাছে। দেবতাকে
'বিগ্রহ' জ্ঞানে নিয়ম-আচারে
বেঁধে, স্বল্পদিনেই 'গলগ্রহে' পরিণত না ক'রে, পরমাত্মীয় জ্ঞানে
প্রতিষ্ঠা করার মহান ঐতিহ্য
এই বঙ্গের ইতিহাসের পাতায়
প্রতি ছত্রে ছত্রে লেখা
আছে। এখানের
বহু মাতৃপীঠ তথা সাধনপীঠ রয়েছে
যেগুলির পরিচয় যেমন আমাদের
অজানা তেমনই সেসবের মহিমা
সম্পর্কেও আমরা ওয়াকিবহাল নই।
তেমনই
একটি মাতৃপীঠ তথা সাধনপীঠ, বর্ধমান(অধুনা পূর্ব বর্ধমান)
জেলার বড়বেলুন।
বড়বেলুন
গ্রামের পূর্বনাম বিল্বপত্তন। এই
গ্রামের যথার্থ পরিচয় জানার
জন্য আগে গ্রামের ভট্টাচার্য্য
পরিবারের ইতিহাস জানা বাধ্যতামূলক। এই
ভট্টাচার্য্য পরিবারের দৌলতেই এককালে বিল্বপত্তন
গ্রাম সমগ্র বঙ্গদেশের পণ্ডিতসমাজে
সংস্কৃতচর্চার দ্বিতীয় পীঠস্থান(প্রথম তর্কবাগীশ পুর)
রূপে পরিগণিত হ'তো।
ভট্টাচার্য্য
বংশের আদিপুরুষ ছিলেন ভৃগুরাম ভট্টাচার্য্য(বিদ্যাবাগীশ)। তিনি
বর্ধমান জেলারই কেতুগ্রামের সতীপীঠ
বহুলাতীর্থ থেকে পরমাদ্যা মহাশক্তির
প্রত্যাদেশে এখানে আসেন।
দেবীর ইচ্ছানুযায়ী স্থানীয় শ্মশানে পঞ্চমুণ্ডীর আসন প্রতিষ্ঠা করে
সাধনায় মগ্ন হ'ন। নিজের
হাতেই কালীপ্রতিমা তৈরী করে আপনমনেই
পূজো করতেন। আকুল
হয়ে দর্শনের ইচ্ছা প্রকাশ করতেন৷
ক্রমে একদিন সাধনামগ্ন অবস্থায়
দেবী দর্শন দে'ন। কিন্তু
ভৃগুরাম দর্শন পাওয়ার আনন্দে
আত্মহারা হবার পরিবর্তে ভীষণ
ভয় পেয়ে যান।
"এ কোন রূপে আমায়
ধরা দিলে মা? এমন
ভয়ঙ্করী রূপে কেন আমার
কাছে এলে?"। দেবী
অভয়দান করেন, "এই রূপেই আমার
উপাসনা কর। তোর
যে বীরাচার ভাব..! বীরাচারী সাধনার
পরিপন্থী যে প্রকাশ, সেই
রূপেই তোকে ধরা দিলাম".....
দেবী অদৃশ্য হ'ন।
অতঃ দেবীর আদেশানুসারে ভৃগুরাম
বিকটদর্শনা ভৈরবীর
আরাধনা শুরু করলেন।
বর্তমান উত্তরসূরীদের থেকে জানা যায়,
প্রায় চল্লিশ বছর বয়সে
দেবীর আদেশেই মৃত ব্রাহ্মণকন্যা'কে বিভূতিযোগ অবলম্বনপূর্বক
পুনরুজ্জীবিত করে বিবাহ করেন
ভৃগুরাম। ক্রমে
তাঁর পরিচিতি বৃদ্ধি পায়।
শ্মশানবাস ত্যাগ করে পার্শ্ববর্তী
লোকালয়ে চলে আসেন তিনি। তাঁর
পাণ্ডিত্য এবং সাধনায় আকৃষ্ট
হয়ে বহু ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়,
কায়স্থ প্রভৃতি সম্প্রদায়ের লোক বিল্বপত্তনে বসতী
করেন। সঙ্গে
নিভৃতে চলতে থাকে নিত্যসাধনা
ও দীপান্বিতা অমাবস্যায় কালীপূজা। কথিত
আছে, ভৃগুরাম যতদিন জীবিত ছিলেন,
তিনি নিজেই কালীমূর্তি তৈরী
করতেন। তিনিই
ইষ্টদেবীর "বড়মা" নামকরণ করেন।
দেবীর আদেশে যখন তাঁর
অন্তিমকাল আগত, তখন তিন
পুত্র যথাঃ শিবচরণ ন্যায়ালঙ্কার,
শঙ্করপ্রসাদ বেদান্তবাগীশ এবং পীতাম্বর তর্কচূড়ামণি'কে আদেশ দেন,
যাতে তাঁর জাগতিক মোহপাশ
থেকে মুক্তির পরে দেবীর নিত্যসেবা
ও বার্ষিক পূজোর ধারাবাহিকতা অব্যহত
থাকে।
ভৃগুরাম
বরাবরই নিজের সাধন এবং
ইষ্টসেবা সম্পর্কে পরিবারকে কিছুই জানাননি।
তাই, কীভাবে দেবীর সেবাপূজা
হবে, পুত্ররা জানতে চাওয়ায় সাধক
বলেনঃ
"কোজাগরী'তে খড় বাঁধিয়া
গায়ে দিবে মাটি।
মায়ের
জিভ করাইবে নতুন কুলা
কাটি।।
এই মতো চৌদ্দ'হাত
করিয়া গঠন।
তন্ত্রোক্ত
পদ্ধতিতে করিবে পূজন।।
কার্তিকী
অমাবস্যায় বসি নিশিঘোরে।
ভক্তিভরে
পূজিবে মা'রে, এই
মূর্তি গড়ে।।
তিনশোলি*
চালে মা'র নৈবেদ্য
করিবে।
পাঁচপোয়া
নবাৎ-মুণ্ডী তদোপরি দিবে।।
নৈবেদ্য
সাজায়ে দিয়া হয়ে একমন।
সুপক্ব
উৎকৃষ্ট রম্ভা দিবে একপণ।।
ছাগ ও মহিষরক্ত খর্পর
ভরি দিবে।
হোম ও আরতি মায়ের,
কভু না করিবে।।
মশালের
আলো জ্বালি দিবে পূজাকালে।
রাঙাজবা
সাজায়ে দিয়া মা'র
পদতলে।।
পূজা শেষে লুচিমিষ্টি মা'য়ে নিবেদিবে।
আমিষ খিচুড়ি অন্ন, মা'য় ভোগ দিবে।।
এইরূপে
বিধিমতো হয়ে ভক্তিমন।
ঊষালগ্নে
মায়ের পূজা হইবে সমাপন।।
পূজারম্ভে
যেই ঘট করিবে স্থাপন।
বৎসরান্তে
করিবে সেই ঘট বিসর্জ্জন।।
রাখিবে
সম্বৎসর ঘট ঘরের ভিতরে।
করিবে
নিত্যসেবা অতি ভক্তিভরে।।
উদয় হইলে তিথি ভাতৃদ্বিতীয়া।
সেইদিন
বড়মা'র হইবে বিজয়া।।"
এই আদেশ দিয়ে সজ্ঞানে
উত্তরাস্য অভিমুখে আসনে বসে, অন্তিম
শ্বাসবায়ু টেনে নে'ন
ভৃগুরাম। কুম্ভক
যোগে অল্পসময়েই ব্রহ্মরন্ধ্র পথে পুণ্যাত্মা সাধকের
প্রাণশিখা অনন্ত মহানভে মিলিয়ে
যায়। বড়বেলুনের
তৎকালীন মাতৃমন্দিরটি সাধক ভৃগুরামের এক
শিষ্য স্বর্গীয় গণেশ রায় নির্মান
করিয়ে দেন। পরবর্তী
সেই মন্দির নষ্ট হয়ে
যাওয়ায় সাধকের বংশধরগণ আজকের
মন্দিরটি তৈরী করান।
বর্তমান মন্দিরের পশ্চিমদিকে অর্থাৎ সাধক প্রতিষ্ঠিত
পঞ্চমুণ্ডী আসনের দক্ষিণদিকে ভৃগুরামের
অস্থিভস্মের সমাধিমন্দির। আগের
সমাধিমন্দিরটি মাটির ছিলো, এখন
সেটি পাকা ভাবে প্রতিষ্ঠিত
হয়েছে। এটি
সাধকের অধস্তন ত্রয়োদশ পুরুষ
শ্রী কাশীরাম ভট্টাচার্য্য করিয়েছেন।
ভৃগুরাম
প্রবর্তীত পূজাপদ্ধতি সম্পর্কে আমরা জানতে পারি,
পণ্ডিতপ্রবর রামকৃষ্ণ তর্করত্নের পুঁথি থেকে।
এই পদ্ধতি মেনেই এখনও
পর্যন্ত বড়মা'য়ের নিত্যসেবা
এবং দীপান্বিতা অমাবস্যার কালীপূজো হয়ে আসছে।
প্রথানুযায়ী কোজাগরী পূর্ণিমা তিথিতে দেবীর কাঠামোয়
খড় বেঁধে মাটির প্রলেপ
দেওয়া হয়। দীপান্বিতা
পূজার আগের দিন মাটির
কাজ শেষ করে, খড়ি
দেওয়া হয়। পূজার
দিন সকালে দেবীবিগ্রহে রঙ
এবং সাজ পড়ানো হয়। সাবেকি
সাজ ছাড়াও ভক্তদের দেওয়া
মালা, চাঁদমালা, কাপড় সবই বিগ্রহে
পড়ানো হয়। অমাবস্যার
মধ্যরাত্রে ঘটস্থাপন করে পূজোর সূচনা
হয়। সূর্য্যোদয়ের
আগেই দেবীপূজো সাঙ্গ হয়।
এখনও প্রথামাফিক ভট্টাচার্য্য পরিবারের সকল শরিকের নামে
সঙ্কল্প করে পূজো হয়। দেবীর
পূজায় কারণবারি এবং বলি দেওয়া
পশু(ছাগ ও মহিষ)-র রক্ত উৎসর্গের
নিয়ম আছে। আরতি
বা হোমের কোনো বিধান
এখানে নেই। পূজোর
সময়ে বৈদ্যুতিক আলো জ্বালানোর পরিবর্তে
মশাল জ্বালিয়ে পূজো হয়।
আগে ভাতৃদ্বিতীয়ার দিনে দেবীর বিসর্জ্জন
হতো। এখন
সেটি পরেরদিন(তৃতীয়া) হয়। বিসর্জ্জনের
দিন বিকালে দেবীমূর্তি মন্দির
থেকে বের করে আনা
হয়৷ গ্রামের সকল মহিলারা দেবীকে
বরণ করার পরে স্থানীয়
বড় দীঘির উদ্দেশ্যে দেবী
রওনা হ'ন।
আগে ভক্তদের কাঁধে চেপেই দেবী
বিসর্জ্জনের যাত্রায় যেতেন। কিন্তু
বিগ্রহের বিরাট আকার হওয়ায়
এখন পাটাতনের সঙ্গেই লোহার চাকা
বসানো হয়েছে বিসর্জ্জনের সুবিধার্থে।
তথ্যসূত্র
এবং চিত্রেঃ শ্রীমান্ শঙ্খ
No comments:
Post a Comment