ঐতিহ্যের
ইতিহাসপর্বঃ
আজ ইতিহাসের খোঁজে
পরিবারের দুই গুরুত্বপূর্ন সদস্য শ্রীমান্ শঙ্খ এবং সদস্যা শ্রীমতী নন্দিনী বসাক। আজ
আলোচনায় দেবী হংসেশ্বরী মন্দির।
দেবী হংসেশ্বরী। বংশবাটী(বাঁশবেড়িয়া), হুগলী।
১৬৭৩ সালে হুগলী জেলার
পাটুলীর জমিদার রামেশ্বর রায়
নিজের কর্মদক্ষতা ও বিশ্বস্ততার জোড়ে
তৎকালীন ভারতসম্রাট ঔরঙ্গজেবের থেকে "রাজা" উপাধি পান এবং
ভাগীরথীর তীরবর্ত্তী বংশবাটী(বর্তমান বাঁশবেড়িয়া) গ্রাম সমেত ৪০০বিঘা
নিষ্কর ভূমি উপহার হিসেবে
পান। এরপরেই
রাজা রামেশ্বর রায় সপরিবারে পাটুলী
ত্যাগ করে বাঁশবেড়িয়ায় চলে
আসেন। এই
স্থানটি ত্রিবেণী(ভাগীরথী, সরস্বতী ও কুন্তিনদীর সঙ্গমস্থল)
ও ব্যাণ্ডেলের মাঝামাঝি অবস্থিত।
সুশাসনে
রাজ্যপরিচালনা ও সততার জন্য
রাজা রামেশ্বর রায় সম্রাট ঔরঙ্গজেবের
তরফ থেকে পুনরায় "মহাশয়"
উপাধিতে ভূষিত হ'ন। রামেশ্বর
রায়ের আমলেই বাংশবেড়িয়া রাজবংশের
রাজত্বের পরিধি পূর্বদিকে গঙ্গা
পেড়িয়ে উখড়া পরগণা(বর্তমান
বাংলাদেশ অন্তর্ভুক্ত) এবং উত্তরদিকে দিনাজপুর
পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। বর্তমানে
যেসকল ঐতিহাসিক স্থাপত্য নিদর্শনের দেখা এখানে পাওয়া
যায়, সেসবের বেশীরভাগই রাজা
রামেশ্বর রায় মহাশয় এবং
পরবর্তী রাজা রঘুদেব রায়
মহাশয়ের আমলে নির্মিত।
এরপরে
চলে আসি রাজা রঘুদেব
রায় মহাশয়ের পৌত্র রাজা নৃসিংহদেব
রায়(১৭৪১ খ্রীস্টাব্দ- ১৮০২
খ্রীস্টাব্দ)-এর আমলে।
এই আমলই বাঁশবেড়িয়া রাজবংশের
সুবর্ণময় আমল৷ এই সময়েই
যাতায়াতের সুবিধার্থে পাকা রাস্তা নির্মাণ
থেকে শুরু করে, বর্গিআক্রমণ
থেকে রাজধানী রক্ষার উদ্দেশ্যে পরিখা
নির্মাণ সবই হয়েছিলো।
রাজা নৃসিংহদেব রায় মহাশয়ের স্থাপত্যকীর্তির
অন্যতম বিখ্যাত নিদর্শন অনন্তবাসুদেব মন্দির। বঙ্গীয়
ঘরানার টেরাকোটা শিল্পের অন্যতম বিখ্যাত নির্মাণশৈলী
এই মনৃদিরের প্রত্যেকটি অলিন্দে পরিলক্ষিত হয়।
একদা রাজা নৃসিংহদেব রায়,
তীর্থভ্রমণের মানসে তাঁর দ্বিতীয়া
পত্নী রাণী শঙ্করী এবং
পরিবারবর্গ সমেত বেনারসে যান। তীর্থমাহাত্ম্যের
জোড়ে অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই
রাজা নৃসিংহদেব আধ্যাত্মিকতায় আকৃষ্ট হয়ে পড়েন
এবং বিশ্বনাথ মন্দিরের পুরোহিতদের সহায়তায় প্রাচীন হিন্দুধর্মের বেশ কয়েকটি গ্রন্থের
নিয়মিত পাঠ নিতে শুরু
করেন। অতঃ
পুরোহিতদেরই পরামর্শে "শক্তিবীজ" দীক্ষা নে'ন৷
পাঠের অন্তর্ভুক্ত "হংসবতী ঋক্" এবং
"কুণ্ডলিনী তন্ত্র" শাস্ত্রের প্রতি তিনি এতটাই
আকৃষ্ট হয়ে পড়েন যে,
পঠিত শ্লোক বা মন্ত্রের
চাক্ষুষ বিগ্রহ রূপায়ণে অধীর
হয়ে যান। তীর্থ
থেকে ফিরে এসেই, রাজজ্যোতিষির
পরামর্শে 'হংসবিদ্যা ও কুণ্ডলিনীতন্ত্র'-র
সমন্বয়কারী এক অভূতপূর্ব দেবদেউল
নির্মাণের সিদ্ধান্ত নে'ন।
১৭৯৮ খ্রীস্টাব্দে মন্দিরের নির্মাণকার্য্য শুরু হয়।
মন্দিরের অলঙ্করণ ও বিভিন্ন বিগ্রহ
নির্মাণের উদ্দেশ্যে তৎকালীন লক্ষাধিক অর্থব্যয় করে রাজস্থান থেকে
সাদা মার্বল পাথর এবং
দলমা-রাজমহল পাহাড় থেকে
কোষ্টিপাথর আনানো হয়।
প্রত্যক্ষ পরিচালনায় রাজার স্বপ্ন বাস্তবায়নের
পথে একটু একটু করে
এগোচ্ছে.... কিন্তু, বিধি যেন বাম। আকস্মিক
অসুস্থতায় দিনকয়েকের জ্বরে ভুগেই রাজা
নৃসিংহদেব ইহলোকের মায়া ত্যাগ করলেন। সদ্য
বিধবা স্ত্রী শঙ্করী দেবী
চোখের জল মুছে, মৃত
স্বামীর অপূর্ণ সাধকে সম্পূর্ণ
করার মানসে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে
সিংহাসনে বসেন। তৎকালীন
পর্দানশীন সমাজব্যবস্থায় একজন স্ত্রী-য়ের
রাজত্ব পরিচালনাকে কেউই খুব একটা
ভালো নজরে দেখেননি।
তাঁর বিরুদ্ধে আড়ালে চক্রান্ত চলতে
থাকে। কিন্তু
সেসব কোনোকিছুরই তোয়াক্কা না করে, রাণী
শঙ্করী শাসক হিসাবে কঠোর
হাতে "শিষ্টের পালন ও দুষ্টের
দমন" কার্য্যের একজন ন্যায়নিষ্ঠ ব্রতচারীর
ভূমিকাই আমৃত্যু পালন করে গেছেন।
যাইহোক,
মৃত্যুর আগে রাজামশাইয়ের শেষ
ইচ্ছা অনুযায়ী রাণী শঙ্করী দেউল
নির্মাণের কাজ সুষ্ঠুরূপে সাঙ্গের
কাজে ব্রতী হ'ন। তন্ত্রশাস্ত্রের
পুঁথিগত তত্ত্বকেই বস্তবের প্রেক্ষাপটে তুলে ধরার মানসেই
রাজা আপন ইষ্টদেবী "রাজরাজেশ্বরী"-র মন্দির নির্মাণের
পরিকল্পনা নে'ন।
সই মতোই, তন্ত্রের "ষটচক্রভেদ"
যোগ, "পঞ্চনাড়ী" তত্ত্ব এবং চন্দ্রের
ত্রয়োদশ প্রদক্ষিণের জটিল তত্ত্বকেই তুলে
ধরা হয়, 'হংসবিদ্যা'র
অধিষ্ঠাত্রী দেবী ত্রিপুরাসুন্দরী তথা
রাজা নৃসিংহদেবের ইষ্টদেবী শ্রী শ্রী হংসেশ্বরীর
মন্দিরগাত্রে।
মন্দিরের
গঠনশৈলীতে লক্ষ্য করা যায়
যে, সমগ্র দেউলটি পাঁচটি
তল বিশিষ্ট। যা
কিনা, প্রকৃতিসাধকের অন্যতম প্রধান সংযম
ঊর্ধ্বরেতা প্রক্রিয়ার পর্যায়ক্রমিক পাঁচটি নাড়ীকে নির্দেশ
করে। যথাঃ
বজ্রাক্ষ, চিত্রিণী, ঈড়া, পিঙ্গলা ও
সুষুম্না। মন্দিরের
তেরো(১৩)টি চূড়ার
গঠন প্রস্ফুটিত পদ্মকুড়ির মতো। যা,
বারো(১২)টি অমাবস্যার
আগমনকাল অন্তর্বর্তীকালীন তেরো(১৩)বার
চন্দ্রের প্রদক্ষিণতার রূপক। শীর্ষদেশ
ব্যতীত বাকী চূড়াগুলির নীচে
একটি করে কোষ্টিপাথরের শিবলিঙ্গ
প্রতিষ্ঠিত রয়েছেন। শীর্ষস্থানীয়
চূড়ার নীচে শ্বেতপাথরের শিবলিঙ্গ
প্রতিষ্ঠিত। এই
মন্দিরে একাধিক চূড়া(রত্ন)-র উপস্থিতি লক্ষ্য
করে, অনেকেই ভুলবশতঃ একে
'রত্নশৈলী'-র মন্দির বলে
থাকেন। আদতে
তা কিন্তু নয়।
এটি সম্পূর্ণ একক স্থাপত্যরীতিতে গঠিত
গূঢ় সাধনতত্ত্বের চাক্ষুষ নিদর্শন বিশেষ।
শীর্ষদেশীয়(পাঁচতলার) চূড়ার ঠিক নীচেই
একতলায় গর্ভগৃহে স্বয়ং শ্রীবিদ্যা তথা
হংসবিদ্যার অধিষ্ঠাত্রী দেবী রাজরাজেশ্বরী ত্রিপুরাসুন্দরী,
শ্রী শ্রী হংসেশ্বরী মাতা
নামে অধিষ্ঠিতা। গর্ভমন্দিরটি
বৃত্তাকরা। বিগ্রহটি
নিমকাঠের তৈরী। কোষ্টিপাথেরে
তৈরী সহস্রদলের উপরে দক্ষিণাস্য হয়ে
দেবাদিদেব শায়িত। তাঁর
নাভিকূণ্ড থেকে একটি পদ্ম
নির্গত হয়েছে। সেই
পদ্মের উপরে ললিতাসনে অধিষ্ঠিতা
চতুর্ভূজা মাতৃমূর্তি। চারহাতে
যথাক্রমে খড়্গ, নরমুণ্ড, বর
এবং অভয় মুদ্রায় স্মিতহাস্যময়ী
ত্রিনয়নী জগন্মাতার নয়নাভিরাম শ্রীবিগ্রহ। দেবীর
গায়ের রঙ উজ্জ্বল নীলবর্ণ। আমাদের
শাস্ত্র বলেছেন, প্রতিটি জীবই নিয়মিত 'হংস'
মন্ত্র জপ করে চলেছে। প্রশ্বাস
গ্রহণের সময়ে যে ছন্দে
বায়ু নাসিকা দ্বারা গৃহীত
হয়, তার উচ্চারণ 'হং'
এবং নিঃশ্বাসবায়ু ত্যাগের সময়ে বায়ু 'সঃ'
ছন্দে নাসিকা থেকে বর্জিত
হয়। তাই
'হংসঃ' এই মন্ত্রকে "অজপা"
বলা হয় অর্থাৎ, যে
জপের জন্য কোনো নিয়মানুবর্তীতার
প্রয়োজন হয়না, আপনা থেকেই
স্বাভাবিক শরীরবৃত্তীয় চাহিদানুযায়ীই অনবরত জপ হয়ে
চলে, তাই "অজপা"। এই
অজপা মন্ত্র নিয়ন্ত্রিত হয়
নিষ্ক্রিয় পরমপুরুষ এবং সক্রিয় পরমাপ্রকৃতি
দ্বারা। সেই
গূঢ় তত্ত্বই এখানে রাজা নৃসিংহদেবের
মানসপটে প্রকটিতা শিবশক্তির মিলিত প্রকাশ 'হংসেশ্বরী'
নামে নিত্যসেবিতা।
দেবীর
গর্ভগৃহের বহির্গাত্রে অপূর্ব সুন্দর ফ্রেস্কো
এবং পঙ্খের কাজ।
দেবীর ঠিক সামনেই গর্ভমন্দিরের
বাইরেই একটি ফোয়ারা রয়েছে। হয়তো,
রাজত্বকালে নিয়মিত জলের ধারা
বইতো এখানে।এখন
চারদিক থেকে ঘেরা আছে।
মন্দিরের
প্রতিষ্ঠাকাল ১৮১৪ খ্রীস্টাব্দ।
রাজপরিবারের
তত্বাবধানে যেভাবে নিত্যপূজা বা
বছরের বিভিন্ন সময়ে আয়োজিত মহোৎসবের
যে সূচনা হয়, সেসবের
আজ আর কিছুই অবশিষ্ট
নেই। এমনকি,
দেবীর সেবাপূজার বিধিতেও বহু পরিবর্তন হয়েছে। বর্তমান
মন্দিরের স্বল্পশিক্ষিত পুরোহিতরা দেবীকে "কালী" রূপে আরাধনা করেন। তাঁদের
দৌলতে স্থানীয় এবং বহিরাগত ভক্তরা
জেনেছেন যে, মন্দিরে অধিষ্ঠিতা
বিগ্রহটি একটি কালীমূর্তি।
এমনকি, দেবীর পুষ্পাঞ্জলী মন্ত্রেও
"কালীর মূলমন্ত্র" ব্যবহার করা হয়।
এসব ঘোর অনুচিত।
কেবলমাত্র, রূপসাদৃশ্যের কারণে একজন দেবীকে
অন্যদেবী রূপে উপাসনা করা
এমনকি "বীজমন্ত্র"-এর ক্ষেত্রেও অন্য
দেবীর মন্ত্র ব্যবহার... এসব
দেখেশুনে যারপরনাই খারাপ লাগে।
যাক, এসব তার্কিক বুদ্ধি
বা দিয়ে আসল প্রসঙ্গে
আসি। মন্দিরের
সামনেই রাজবংশের ছাদহীন ভাঙাচোরা নহবতখানা। একটু
দূরেই রাজবাড়ী। মন্দিরের
পশ্চিমদিকেই অনন্তবাসুদেব মন্দির। দেবীর
সঙ্গে সঙ্গে এই মন্দিরে
রাধাগোবিন্দ জিউ, জগন্নাথ প্রমুখ
দেবতাদেরও নিত্য উপাসনা হয়। পূর্বদিকে
ভোগশালা। সেখানে
রোজ দুপুরে বসিয়ে ভোগ
খাওয়ানোর ব্যবস্থা আছে। বর্তমানে
ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের অধীনে মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণের
ভার আসায়, অত্যন্ত সুচারু
ভাবে মন্দির সংস্করণ, বৈদ্যুতিক
আলোর সুব্যবস্থা এবং মন্দিরকে কেন্দ্র
করে সবুজায়ন হয়েছে। রাজবাড়ী
সমেত সমগ্র মন্দির আঙিনা
পরিখায় ঘেরা। সন্ধ্যার
পরে চতুর্দিকের বৈদ্যুতিক আলোর ঝর্ণায় দেউলের
অলিন্দে অলিন্দে আলোর শোভা..... সত্যিই,
মন ভরে যাবার মতো।
এখানে
প্রতি সপ্তাহের মঙ্গল-শনিবার, ছোটোবড়
বিভিন্ন অনুষ্ঠান, শারদীয়া দুর্গোৎসব, দীপান্বিতা কালীপূজায় প্রচুর ভক্তসমাগম হয়। দেবীর
বিশেষ পূজাতে বলিদানের বিধানও
রয়েছে। নিত্যনৈমিত্তিক
সেবার ক্ষেত্রে, ভোরে মঙ্গলারতির পরে
মন্দিরের দরজা খোলা হয়। দুপুর
বারো(১২)টা অব্দি
নিয়মিতভাবে দর্শন ও পূজো
নিবেদন হয়ে থাকে।
মধ্যাহ্নে ভোগারতির পরে বিকাল চার(৪)টে অব্দি
মন্দির বন্ধ থাকে।
এরপরে, আবার খোলা হয়। সন্ধ্যা
সাত(৭)টা অব্দি
দর্শন, নাম সংকীর্তন, পূজো
নিবেদন, সবই হয়ে থাকে। অতঃ
শয়নারতি হয়ে মন্দির বন্ধ
করা হয়। দর্শনীয়
স্থান হিসাবে বা দেবদেউল
হিসাবে অন্তরাত্মার পুষ্টি সাধনের ক্ষেত্রে
এই স্থানের জুড়ি মেলা ভার। তবে,
যখনই লৌকিকতা ও সংস্কারের বশবর্তী
হয়ে কিছু অজ্ঞের স্বল্পবুদ্ধিতা
গর্ভগৃহের দ্বারে পুরোহিত বেশে
পূজো দেওয়ায়, তখনই মন খারাপ
হয়ে যায়। বলারও
কোনো জো নেই।
এক বোঝাতে গিয়ে আরেক
মানে হয়ে দাঁড়াবে।
তখন নিজেকেই নিজের হেয় করা৷
তাই যাক না, যে
যেভাবে নিয়ম সংস্কারের বাঁধুনিতে,
লৌকিকতার বেড়াজালে মন্দিরাধিষ্ঠাত্রীকে বাঁধে বাঁধুক।
আসল কথা তো, মনের
বিশ্বাস ও ভক্তি।
আমি জানি, আমি কাকে
কীরূপে কীভাবে কী উপচারে
সেবা করি। তাতেই
আমার আত্মার সন্তুষ্টি।
কৃতজ্ঞতা
স্বীকারঃ
যাত্রা
পরিকল্পনাঃ শ্রীযুক্ত দীপায়ন রায়চৌধুরী।
তথ্য সহায়তাঃ শ্রীযুক্তা নন্দিনী বসাক।
No comments:
Post a Comment