ঐতিহ্যের
ইতিহাসপর্বঃ
আজ আবারও এক
অন্নপূর্ণা পূজার ইতিহাস তুলে
ধরলাম আমরা বনেদীয়ানা র
সদস্যরা। আজ
আলোচনায় কৃষ্ণভবনের শ্রীশ্রীঅন্নপূর্ণা ঠাকুরাণীর পুজো, এবছর তা
১৭২বছরে পদার্পণ করল। কীভাবে
পুজো হয় বা কেন
এই পুজোর সূত্রপাত তা
নিয়েই আলোচনায় পরিবারের সদস্য শ্রীমান্ সায়ন্তন
দাস আর সংগ্রহে শ্রীমান্
শুভদীপ।
কৃষ্ণভবনের পুজো শুরু হয়েছিল
১৮৪৭ সালে পরিবারের পুর্বপুরুষ
শ্রী কৃষ্ণ চন্দ্র দাস
মোদকের হাত ধরে।
এই পরিবারের একটি মিষ্টান্ন ভান্ডার
আছে, তার নাম 'কৃষ্ণ
চন্দ্র দাস মোদক এন্ড
সন্স'। সেই
দোকানেরই এক কর্মী দেবীর
এক মৃন্ময়ী বিগ্রহ এই দাস
মোদক পরিবারের বাড়ির
বাইরের বৈঠকখানায় বসিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন।
সেই মৃন্ময়ীমূর্তিই কৃষ্ণ
চন্দ্র ঘরে নিয়ে আসেন
আর পুজো শুরু করেন,
কারণ তাঁর বিশ্বাস ছিল-"মা নিজে যখন
তার গৃহে এসেছেন, তখন
তাকে কী বাড়িতে না
তুলে থাকা যায়?" খিদিরপুর
অঞ্চলের এই দাস পরিবারে
পুজো শুরু হল মা
অন্নপূর্ণার, যা আজও একই
ধারায় হয়ে আসছে।
আগে দাস মোদক পরিবারে দেবীকে
বহু নৈবেদ্য প্রদান করা হত,
যা কালের বিবর্তনে কিছুটা
কমে গেছে, তবে ফল,
চিনি, চালের এবং মিঠাইয়ের
নৈবেদ্য আজও দেখা যায়
এই পরিবারে। এই
পরিবারের বাড়ির মহিলারা তৈরী
করেন নানান রকমের 'নাড়ু',
যেমন নারকেলের নাড়ু, ক্ষীরের নাড়ু,
তিলের নাড়ু ইত্যাদি।
দাস পরিবারে মাকে অন্নভোগ দেওয়া
হয় না কারণ তাদের
রীতি হল এই ঠাকুরদালানে
অন্ন উঠবে না তাই। তাই
দেবীকে লুচিভোগই প্রদান করা হয়। ভোগে
থাকে- লুচি, পাঁচ রকমের
ভাজা, পাঁচ রকমের তরকারি
এবং মিষ্টান্ন। এই
ভোগ রান্না করেন একমাত্র
ব্রাহ্মণ পরিবারের পুত্রবধূরাই, তাদের দিয়েই রান্না
করানো হয় দাস পরিবারে। পরিবারে ১০৮ দীপ প্রজ্জ্বলনেরও প্রথা রয়েছে দাস মোদক পরিবারে।
এই পরিবারের পুজোর
বিশেষ আকর্ষণ হল "ধুনো
পোড়ানো", অর্থাৎ বাড়ির বউরা
দুই হাতে এবং মাথার
ওপর সরা নিয়ে বসে
মায়ের উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করেন, এই প্রথা
দাস পরিবারে প্রাচীন কাল থেকেই হয়ে
আসছে। এছাড়াও
পরিবারে কুমারিপুজোও রয়েছে এবং "সদবা-পুজো"র প্রথাও রয়েছে। অন্নপূর্ণা
পুজোর দিন হোমযজ্ঞ, এবং
নিয়ম মেনেই পালিত হয়
দাসভবনের ঠাকুরদালানে দেবীপূজা।
আগে এই পরিবারের
পুজোতে দরিদ্র নারায়ণ সেবা
হত যা বর্তমানে আর
প্রচলিত নেই। এছাড়া
কাদা-মাটি খেলার প্রচলন
ছিল বিসর্জনের আগে।
পরিবারের কুলদেবতা রাধাগোবিন্দ, তার নিত্য সেবাপুজো
হয় পরিবারে তাই এই পূজার
অষ্টমীতে রাধাগোবিন্দের দোল হয় ঠাকুরদালানে। অঞ্জলির
পর মহাদেবকে ভিক্ষাদান করা হয় একটি
মাটির খুড়িতে, এই ভিক্ষাদান পর্বে
থাকে একমুঠো চাল, নাড়ু,
পৈতে, একটি কাঁচা আম
ও একটি টাকা।
অন্নপূর্ণা পূজা ছাড়াও এই
পরিবারে ঘরোয়া ভাবে ধান্যলক্ষ্মীপূজাও
হয়ে থাকে। পুজোর
দুদিন আগে লক্ষ্মীদেবী ঠাকুরদালানে
অবস্থান করেন এবং পরদিন
বিসর্জনের আগে ধান্যলক্ষ্মীকে ঠাকুরঘরের
সিংহাসনে রেখে আসা হয়। ধান্যলক্ষ্মীদেবী
পূজার দিন সকালে মায়ের
সাথে ঠাকুরদালানে উপস্থিত হন। এরপরই
দেবীর দর্পনে বিসর্জন পর্ব
অনুষ্ঠিত হয়। পারিবারিক
প্রথানুসারে এই লক্ষ্মীদেবীর পূজাকে
হাঁড়ির লক্ষ্মী পূজাও বলা হয়। কারণ
যে ধান দিয়ে দেবীকে
গড়া হয়, সেই ধান
একটি মাটির হাঁড়িতেই থাকে। পুজোর
পরদিন রামনবমীর পুজোও হয়ে থাকে
দাস মোদক পরিবারে।
দাস মোদক পরিবারে কনকাঞ্জলিপথাও রয়েছে। বিসর্জনের
সময় পরিবারের মহিলারা সিঁদুর খেলায় মেতে
ওঠেন। তারপর
মায়ের বিদায়বেলায় নিরঞ্জনের পথে নিয়ে যাওয়া
হয়। বিসর্জন
শেষে দেবী প্রতিমার কাঠামো
নিয়ে আসা হয়।
প্রাচীন কাল থেকে একই
কাঠামোতে দেবীর মৃন্ময়ীমূর্তি তৈরী
করা হয়। এইভাবে
একচালায় মা, মহাদেব, নন্দীমহারাজ,
জয়া এবং বিজয়ার সাথে
প্রাচীন কাল থেকে পুজো
পেয়ে আসছেন খিদিরপুরের দাস
মোদক পরিবারে।
কৃতজ্ঞতাস্বীকারঃ
শ্রীমান্ সায়ন্তন দাস
তথ্যসংগ্রহেঃ
শ্রীমান্ শুভদীপ রায় চৌধুরী
No comments:
Post a Comment