"বনেদীর-বনেদীয়ানা" পরিবার
বারবার প্রমাণ করেছে তাদের
স্বতন্ত্র গবেষণা। আজ
আবারও এক অনন্য ইতিহাসের
খোঁজে পরিবারের সদস্যবৃন্দ। গুরুত্বপূর্ন
সদস্য শ্রীমান্ শঙ্খ তথ্যসূত্র নিয়ে
এলেন। আজ
রায়-মুখার্জ্জী পরিবারের "শারদীয়া" দুর্গোৎসব। "বনেদীর-বনেদীয়ানা"
পরিবারই পারে বিভিন্ন স্থানের
ইতিহাস, ঐতিহ্যের খোঁজ নিয়ে আসতে
এবং তা তাদের নিজেস্ব
ব্লগ, ওয়েবসাইট এবং বহু পরিচিত
বিভিন্ন ওয়েবসাইট, পত্রপত্রিকায় তুলে ধরতে।
এখানেই অন্য সমস্ত সংগঠনের
থেকে বনেদীয়ানা পরিবার অনন্য ইতিহাস
ও ধারাবাহিকতা তুলে আনতে সক্ষম।
বর্ধমান
সদর থেকে সিউড়ি রোড
ধরে বোলপুরের পথে বাঁদিকের এক
বর্ধিষ্ণু গ্রাম 'রামচন্দ্রপুর', বলা
ভালো 'রায়-রামচন্দ্রপুর'।
গ্রামের সদ্যনির্মিত পাকা রাস্তার দু'ধারে কিছু ভাঙা,
বিগ্রহহীন শিবমন্দির, কড়িকাঠ ভেঙেপড়া নহবতখানা,
ব্যবহারের অযোগ্য কিছু পুকুরের
বাঁধানো বিরাট বিরাট ঘাট,
আর ছাদহীন খিলানসর্বস্ব ঠাকুরদালানের
নাটমন্দির...... এদেরও বোধহয় মনে
নেই যে, 'রামচন্দ্রপুর' কবে
থেকে 'রায়-রামচন্দ্রপুর' হয়েছে!
হয়তো একজনের কাছে এর
উত্তর মিলবে, সময়ের কাছে!
কিন্তু সেই সময়'ই
যেন এখানে নিজেই স্তব্ধ
করে রেখেছে! নিজের গতিতে কালচক্রের
অন্ধকারে সবকিছুকে গ্রাস করলেও রায়-রামচন্দ্রপুরের জমিদারবাড়ীকে গ্রাস করেনি।
যেন সময় নিজেই নিজেকে
এক বনেদীয়ানার ঐতিহ্যে বেঁধে রেখেছে! তাইতো,
আসেপাশের আর পাঁচটা গ্রামের
মতো রামচন্দ্রপুরেও শহুরে আধুনিকতার রঙের
প্রলেপ পড়লেও জমিদার 'রায়-মুখার্জী'দের বাস্তু যেন
দুর্ভেদ্য প্রাচীরে সেই আধুনিকতার অবাঞ্ছিত
গতিকে স্তব্ধ করে রেখেছে। সে
যেন, এখনও এক অপ্রকাশিত
ইতিহাসের নীরব গাথা রচনায়
ব্যস্ত। কবে
শেষ হবে, কে জানে...!
বেশীরভাগ তথ্যই যে বিনষ্ট...!
তবুও সে অনড়!
রায়বাড়ীর
চারদেওয়ালে এখনও যেন কান
পাতলে শোনা যায়, ভোরের
নহবতখানায় ভৈরবীর মূর্চ্ছনা, ঠাকুরচাকর
দাসদাসীদের কলরব, কাছারীবাড়ীতে নায়েবগোমস্তাদের
হরদম যাতায়াত, খরম'পায়ে হেঁটে
চলা জমিদারমশাইয়ের আভিজাত্যপূর্ণ পদধ্বনি, অন্তঃপুরবাসিনীদের আলতারাঙাপায়ে নূপুরের শব্দে-হাসিঠাট্টায় প্রাণোচ্ছল
বাড়ীর আনাচে-কানাচে, কুলদেবতা
রাধামোহনের মন্দিরে মঙ্গলারতির ঘন্টাধ্বনি, সন্ধ্যায় দেউড়ীতে পাহারারত প্রহরীদের কাশীদাসী মহাভারতের আবৃতিপাঠ..... আর শোনা যায়
শারদপ্রাতে আনন্দময়ীর আনন্দভবনে আগমণবার্তার কিছু চিরন্তন প্রথায়!
কথা হচ্ছিল, বর্তমান প্রজন্মের রায়বংশের বংশধর শ্রী পিনাকী
মুখার্জ্জী মশাইয়ের সাথে। ওনার
থেকেই জানলাম, আনুমানিক চারশো(৪০০) বছর
আগেকার ধূলিধূসরিত, অস্পষ্ট হয়ে আসা ইতিহাসের
পঙক্তি থেকে উদ্ধার করা
পারিবারিক দুর্গোৎসবের সূচনালগ্নের কথা। তখন
কোথায় রামচন্দ্রপুর! তখনও সে 'রায়'
শিরোপাতে ভূষিত হয়নি।
তখন বছর বছর "গিরিবালা"-র পিত্রালয় আগমনের
আয়োজন হতো বীরভূমে, অজয়নদের
কূলে জলদ্গ্রাম অঞ্চলে। সেখানেই
নাকী রায়পরিবারের আদি ভদ্রাসন।
সেখানেই বার্ষিক শারোদৎসবের প্রায় শতাব্দীকাল যাবৎ
আয়োজন হয়ে এসেছে।
লীলাময়ীর লীলা বোঝে, কার
সাধ্যি! তার হয়তো বছর
বছর আর একই বাড়ীতে
আসা আর পোষাচ্ছিলো না। সেই
অনিচ্ছা'ই একবার, অজয়ের
বন্যার রূপধারণ করে রায়দের ভিটেমাটি
সব তছনছ করে দেয়!
বাড়ীর তৎকালীন কর্তামশাই স্বর্গীয় বিশ্বনাথ রায় ভিটেমাটি, জমিদারী..
সব খুইয়ে তখন কপর্দকহীন..!
মাথার উপরের ছাদটুকুও নেই। অজয়ের
সর্বগ্রাসী ক্ষুধায়, সেসব ধ্বংস......! তখনও
আমাদের পল্লীকবি কুমুদরঞ্জন মল্লিকের লেখনিতে,
"বাড়ী
আমার ভাঙনধরা অজয়নদের বাঁকে,
জল সেখানে সোহাগভরে স্থলকে
ঘিরে রাখে...."
এই ছন্দবদ্ধ পঙক্তি ধরা পড়েনি।
যাইহোক,
সদ্য বিপর্যস্ত্য জমিদার বিশ্বনাথ রায়
বৃথা অশ্রুপাতে সময়নষ্ট না করে, দুই
তরুণ পুত্র রামকান্ত ও
কমলাকান্তের হাত ধরে, কুলদেবতা
শ্রী শ্রী রাধামোহন-রাধারাণী'কে বুকে আগলে
নতুনকরে ঘর বাঁধার আশায়
পথ ধরলেন। দু'দিন এখানে, দু'দিন ওখানে থাকতে
থাকতেই এসে পড়েন রামচন্দ্রপুরে। এক
সজ্জন ব্রাহ্মণের আশ্রয়ে ওঠেন।
পেটের দায়, বড় দায়!
প্রৌঢ় পিতার কষ্ট বুঝতে
পেরেই দুই ভাই, রামকান্ত
ও কমলাকান্ত কাজের সন্ধানে বেড়িয়ে
পড়েন। বেশ
কয়েকদিনের মধ্যেই কাজও জুটে
যায়। রামকান্ত
কাজ পান, তৎকালীন বর্ধমান
রাজবাড়ীর পাকশালায়, সহকারী রাঁধুনি হিসাবে। কমলাকান্ত
কাজ ধরেন রাজপরিবারেরই মন্দিরে
সহকারি পুরোহিতের। কোথায়
ছিলেন জমিদার বংশের কুলপ্রদীপ। আর
সময়ের চাকায় কোথায় এসে
পড়লেন! কিন্তু ভাগ্যলক্ষ্মী যেন
ছক কষেই এসব কাণ্ড
করাচ্ছিলেন। দৈবের
দুর্বিপাকে নাজেহাল করছিলেন রায়দের!
তখন বর্ধমানে মহারাজাধিরাজ কীর্তিচন্দ্র মোহতাব বাহাদুরের রাজত্বকাল। হঠাৎই
মহারাজের কানে একদিন খবর
এলো, দুই নবীন কর্মচারীর
কর্মদক্ষতা, কর্মকুশলতার বর্ণনা। নিজে
পরোখ করার জন্য হুকুম
জারি করলেন যে, "নতুন
রাঁধুনির রাঁধা ভোগে আজ
গৃহদেবতার সেবা হবে।
আর ভোগ নিবেদনাদি যাবতীয়
নিত্যসেবার কাজও অপর নতুন
পুরোহিতই করবে। সর্বোপরি,
মহারাজের প্রত্যক্ষ উপস্থিতিতে।" কিইবা আর
করা যায়, অগত্যা ভয়ে
ভয়েই দু'ভাই প্রস্তুতি
নিয়ে কোমরবেঁধে কাজে নামলেন।
যথাসময়ে মহারাজ উপস্থিত।
প্রথমে পাকশালা, তারপরে ঠাকুরঘর।
প্রসন্নচিত্তে পূজো দেখে, প্রসাদ
মুখে দিয়েই মহারাজ যারপরনাই
আপ্লুত। আহা,
কি স্বাদ! যেন অন্নপূর্ণা
স্বয়ং রাঁধুনির হাতে ভর করে
রেঁধে গেছেন!
ডেকে পাঠালেন দু'জনকে।
নাম, ধাম, পিতৃপরিচয় সবিস্তারে
জানার পরে হৃষ্টচিত্ত মহারাজ
বললেন, "আজ থেকে আর
তোমাদের এবাড়ীতে হেঁসেল আর ঠাকুরঘর
সামলানোর দরকার নেই।
যাও, রামচন্দ্রপুর মৌজাটাই তোমাদের নামে লিখে দিলাম। সেখানকার
জমিদারীটা সামলাও গিয়ে!"
নিজেদের
কান'কে যেন বিশ্বাস
করতে পাড়ছেন না দু'ভাই! মহারাজ ঠিক
বলছেন তো! যা শুনছি,
সজ্ঞানে শুনছি তো! মহারাজ
তাদের মনোভাব বুঝতে পেরে,
আস্বস্ত করে পূর্বোক্ত প্রতিশ্রুতির
পুনরাবৃত্তি করলেন। আনন্দে
আত্মহারা রামকান্ত ও কমলাকান্ত বাড়ী
ফিরলেন, হাতে মহারাজের তরফ
থেকে পাওয়া জমিদারীর ফরমান। প্রৌঢ়
বিশ্বনাথের চোখের জল আর
বাঁধ মানে না! কপালের
ফেরে অকস্মাৎ জমিদারী হারানোয় যতটা না মর্মাহত
হয়েছিলেন, আজ তার সহস্রগুণ
আনন্দে চোখের নোনা জলেও
অমৃতের স্বাদ!
পিতার
আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে, জমিদারীতে
পা রাখলেন রামকান্ত রায়
ও কমলাকান্ত রায়। নিজেদের
দক্ষ পরিচালনায় আর দায়িত্ববোধে তৈরী
করলেন এক বিরাট জমিদারী। সঙ্গে,
নহবতখানা, রাধামোহন মন্দির, শিবমন্দির সহ দুর্গাদালান।
ভেবেছিলেন, হয়তো এ'কাঠামোয়
আর মাতৃআরাধনা সম্ভব হবে না!
কিন্তু কে বলতে পারে,
বিধাতৃবরদা করুনাময়ীর ছলনা কাকে কোন
পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে কোথায়
টেনে আনবে!
সন্তানস্নেহে
প্রজাদের আপন করে নেওয়ায়,
ক্রমে ক্রমে গ্রামের নামই
হয়ে উঠলো "রায়েদের রামচন্দ্রপুর", যা আজকে সংক্ষেপে
"রায়-রামচন্দ্রপুর"। বেশ
কয়েকবছর সুষ্ঠুভাবে জমিদারী সামলানোর পরে আবার এক
পারিবারিক দুর্গোৎসবকে ঘিরে বিবাদের অশনিসংকেত
ঘনিয়ে আসে। ছোটোভাই
কমলাকান্ত এক তান্ত্রিকগুরুর কাছে
দীক্ষা নিয়ে পূজোয় পশু
বলিদানের নিয়ম চালু করার
প্রস্তুতি নিতেই, বৈষ্ণব মনোভাবাপন্ন
রামকান্ত ঘোরতর বিরোধিতা করেন। যে
ভদ্রাসনে দু্র্গাদালানের পাশেই রাধামোহন প্রতিষ্ঠিত
রয়েছেন, সেখানে পশু বলিদান!
এই নিয়ে বিবাদ সাংঘাতিক
পর্যায়ে যায়। অবশেষে
বহু বাগবিতণ্ডার পরে গুরুর আদেশে
কমলাকান্ত রায় গ্রামেরই এক
বটগাছের নীচে, যেখানে কমলাকান্ত
নিজের সাধনবেদী ছিলো, সেখানেই ইষ্টদেবী
শ্রী ভদ্রকালীর প্রস্তরময়ী বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন
এবং ইচ্ছানুসারে শারদোৎসবের সময়ে সেখানেই পশু
বলিদানের নিয়ম শুরু করেন। কমলাকান্তের
বংশধরদের মধ্যেই কোনো দুই
তরফের দৌহিত্রবংশীয়রা পরবর্তীকালে উত্তরাধিকার সূত্রে পারিবারিক স্থাবর
সম্পত্তি ও শারদোৎসবের দায়িত্ব
পান। এই
দুই দৌহিত্র তরফের মধ্যেই একটি
তরফ, উত্তরপাড়া মুখার্জ্জী পরিবারের একটি শাখা।
সেই মুখার্জ্জী পরিবার, যাঁদের আদিপুরুষ হলেন
কণৌজ আগত ভরদ্বাজ গোত্রধারী
সাগ্নিক "মহর্ষি শ্রীহর্ষ"।
অপর দৌহিত্রগণ হালিশহর থেকে এসেছিলেন।
এবারে
দুর্গোৎসব প্রসঙ্গে আসা যাক।
রায় পরিবারের পূজো বা দেবীর
প্রতিমায় কিছু বিশেষত্ব রয়েছে। পাঁচখিলান
বিশিষ্ট ঠাকুরদালানে, সপরিবারে উপস্থিত দুর্গাদেবীর সামনের দু'টি
হাতই যা প্রকাশ্য, বাকী
আটটি হাত খুবই ছোটো
আকারের। সাজের
আড়ালে ঢাকা থাকে।
দেবীর গাত্রবর্ণ অতসীপুষ্পের মতো। সিংহবাহিনীর
সিংহটি এখানে শ্বেতবর্ণের এবং
বৈষ্ণব মুখাকৃতি(ঘোড়াদাবা)। দেবীর
শাকম্ভরী শক্তি 'নবপত্রিকা' বিগ্রহের
বামদিকে, কার্ত্তিকেয়'র পাশে স্থাপিতা। সচারাচর
কোনো সপরিবার দুর্গাপ্রতিমায় কেশ(চুল)বিশিষ্ট
গণেশের অবস্থান লক্ষ্য করা যায়
না। এখানে,
গণেশের মাথায়ও কেশদামের উপস্থিতি
লক্ষ্যনীয়। জমিদারীর
সূচনালগ্নেই দুই ভাইয়ের মনোমালিন্যের
ফলস্বরূপ এখানে দুর্গাবিগ্রহের সামনে
দু'টি শরিকানার দু'টি পৃথক ঘট
বসানো হয়। শারদীয়া
শুক্লা ষষ্ঠীর দিন দেবীর
বিগ্রহ বেদীতে স্থাপনের পরে
প্রথমেই পঞ্চগব্য এবং পঞ্চামৃত সহযোগে
প্রতিমার অঙ্গশুদ্ধি হয়। তারপরে,
সন্ধ্যায় বোধন-অধিবাস হয়ে
থাকে। সপ্তমীর
সকালে নবপত্রিকা স্নান ও ঘটোত্তলন
প্রভৃতি শুভ মহরতের শুভ
সূচনা, ঢাকের আওয়াজে সারা
গ্রামে জানান দেওয়া হয়। রায়বাড়ীর
নবপত্রিকা ও ঘট স্থানীয়
বড়পুকুর থেকে আসার পরেই
গ্রামের অন্যান্য পূজোর ঘটোত্তলনের কাজ
শুরু হয়। রায়বাড়ীতে
পূজোয় পূজক বা তন্ত্রধারকের
আসনে বাড়ীর সদস্যরাই বসেন। বাইরের
পুরোহিতের কোনো ভূমিকা এখানে
নেই। বর্তমানে,
পূজোয় রামকান্তের বংশধর শ্রীযুক্ত শম্ভুনাথ
রায় মহাশয় এবং কমলাকান্তের
বংশধর শ্রীযুক্ত অভিজিৎ মুখার্জ্জী(দৌহিত্র
তরফ) মহাশয় পৌরোহিত্য করেন। পারিবারিক
ঠাকুরদালানের পূজোয় সম্পূর্ণ বৈষ্ণবাচার
মেনেই ক্রিয়াকাণ্ড সামলানো হয়। রায়
ও মুখার্জ্জী উভয় পরিবারেরই সকল
বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্যদের নামে সঙ্কল্প হয়। সপ্তমী,
মহাষ্টমী ও মহানবমী তিথিতে
দেবীর উদ্দেশ্যে ১১টি পৃথক থালায়
১১রকম ভাজা, ডাল, ৫রকম
তরকারি, চাটনি, পায়স সহ
অন্নব্যঞ্জন উৎসর্গ করা হয়। এখানে
দেবীর ভোগে কোনো তেতো(উচ্ছে বা করলা
ইত্যাদি) সব্জীর রান্না হয়না। সন্ধীপূজা
ও তিনদিনের শীতলারতি'তে লুচি, ক্ষীর,
মিষ্টান্ন ইত্যাদি নিবেদন করা হয়। সন্ধীপূজায়
১০৮টি প্রদীপ জ্বালিয়ে ১০৮টি
পদ্মফুল নিবেদন ও আরতি
হয়। আরতির
পরেই মণ্ডপে স্থাপিত হোমকুণ্ডে
যজ্ঞাগ্নি স্থাপন করা হয়। কুলাচার
মেনেই রামকান্তের এক বংশধর এবং
কমলাকান্তের এক বংশধর হোমের
কাজ করে থাকেন৷ উভয়েই
৫০৪টি করে, মোট ১০০৮টি
সঘৃত বেলাপাতার আহূতি দিয়ে বৈদিক
যজ্ঞ সমাধা করেন।
এরপরেই বাড়ীর সধবা মহিলারা
তেল, সিন্দুর, আলতা, পান ও
সুপারি দিয়ে 'এয়োতিবরণ' করে
থাকেন।
মহানবমীর
পূজোর পাঠ মিটলে সেদিন
সন্ধ্যায় পূর্বোল্লিখিত শ্রী শ্রী ভদ্রকালী
মাতার সামনে কমলাকান্তের বংশধরেরা
পাঁঠাবলি দান করেন।
বিজয়াদশমীর
সকালে দেবীর উদ্দেশ্যে মাটির
মালসায় দই, চিঁড়ে, খৈ,
মুড়কি ইত্যাদি নিবেদন করা হয়। এরপরে,
মাটির হাঁড়িতে নতুন শাড়ী, গামছা,
তেল, সিন্দুর, আলতা, শাঁখা, নোয়া,
চিরুনি, আয়না, পান, সুপারি,
লুচি, মিষ্টি ইত্যাদি সাজিয়ে
দেবীর "যাত্রামঙ্গল" হয়। অতঃ
অপরাজিতা পূজা ও ঘট-নবপত্রিকা বিসর্জ্জন হয়। সন্ধ্যায়
বাড়ীর সধবাগণ দেবীকে বরণ
করেন। বরণের
বেলায়ও একটি বিশেষত্ব রয়েছে। কোনো
এক অজ্ঞাত কারণে রায়
পরিবারের কোনো মহিলাই বরণে
অংশগ্রহণ করতে পারেন না। বরণ
করেন, দৌহিত্রবংশীয় মুখার্জ্জী পরিবারের মায়েরা। এরপরে,
শোভাযাত্রা সহকারে বড়পুকুরে প্রতিমা
নিরঞ্জন হয়।
আবার এক বছরের অপেক্ষা। একাদশীর
দিন থেকেই, পরেরবছরের দিনগোনা
শুরু!
ক'দিনের অহোরাত্র মানুষের
উপস্থিতি, ঝলমলে আলোর রোশনাই,
মন্ত্রের গুরুগম্ভীর উচ্চারণ, কচিকাঁচাদের দৌরাত্ম্য, বিভুইয়ের কর্মস্থল থেকে আগত ঘরের
লোকেদের আনাগোনা হাসিঠাট্টায় উৎসবমুখর ঠাকুরদালান, ছাদহীন নাটমন্দির যেন
পুরোনো আমলের স্মৃতিমেদুরতায় ডুবে
থাকে! তাদের প্লাস্টার খসা
দেওয়ালে সাবেকী ইঁটের হাসি
যেন গল্প-দাদুর আসর
সাজাতে চায়! কত কথা,
কত গল্প, কত ইতিহাস,
কত ঘটনার নীরব সাক্ষী
সেই দালান.....! কতকিছুই যেন তার বলার
আছে! কদিনের অনিয়মে যেন
ধ্যানাবিষ্ট গাম্ভীর্য্যের পর্দা সরিয়ে চপল
শিশুর মতো, অলিন্দে অলিন্দে
টাঙানো শামিয়ানা ধরে দোল খেতে
চায়....! সকালসন্ধ্যায় আরতির ঢাকে সেও
যেন পা মেলাতে চায়!
খেয়ালেই থাকে না, ক'টাদিন কীভাবে কেটে
যায়। একদিন
একদিন করে চারদিনের দিন
অকস্মাৎ, "রাজ্যং শূণ্যং, গৃহ
শূণ্যং............মম চ অনুগ্রহার্থায়
পুনরায় গমনায় চ।।"
কথা কানে আসতেই, দোল
খাওয়া শামিয়ানা টেনে যেন বাধা
দিতে চায়! কাতর স্বরে
বলতে চায়, "মা, তুমি যেওনা...!"
দশমীর
প্রতিমা নিরঞ্জনের পর সন্ধ্যারাতে সবাই
যখন যারযার বাড়ীতে বিজয়ার
আনন্দে পরস্পর মগ্ন; কোলাকুলি,
প্রণাম, মিষ্টিমুখ, ক'দিনের উৎসবমুখর
স্মৃতিচারণা, হাসিঠাট্টায় ডুবে, প্রবাসীদের ঘরে
ফেরার ব্যস্ততা..... তখন বয়সের ভারে
ন্যুব্জ নোনাধরা দেওয়াল, প্লাস্টার খসা থাম বোবাকান্না
কাঁদে...! কয়েকদিনের নতুন কাপড়ের আড়ালে,
ঘোমটা টেনে থাকা সাবেকী
বাড়িটা যেন হঠাৎ করে
অশীতিপর বৃদ্ধার বেশ ধরে!
দিন যায়, রাত কাটে.....
ক'দিনের মানুষের পায়ের
ছাপে আল্পনা আঁকা ঠাকুরদালানের
মেঝেতে ধূলো পড়ে, ক'দিনের সরব কোলাহলের
দাপটে, দালানের যারা সারাবছরের অলিখিত
বাসিন্দা, সেই একঘরে হয়ে
যাওয়া পায়রা গুলো আবার
ফিরে আসে। তাদের
বকবকম আওয়াজ শুনতে শুনতে
সুখের স্মৃতিটুকু মনের মনিকোঠায় লুকিয়ে
রায়-রামচন্দ্রপুরের রায়বাড়ী আবার ইতিহাস পুরশ্চরণের
তপস্যায় মগ্ন হয়।
মাঝেমধ্যে যখন তার ভিতরটা
মোচড় দিয়ে ওঠে, দেওয়ালের
গা থেকে একটা একটা
করে চুনসুরকির চোকলা খসে পড়ে,
তখন হয়তো গভীর নিশুতিরাতে
জগৎসংসারকে ঘুম পাড়িয়ে টিমটিমে
প্রদীপ জ্বলা ঠাকুরদালানের স্নেহময়ী
জননী খড়ের কাঠামোর আড়াল
থেকে বেড়িয়ে আসেন।
ঘায়ে হাত বুলিয়ে দেন। সেই
অমৃতস্রাবী স্পর্শের কারণেই হয়তো আশীর্বাদধন্য
রায়বাড়ী, কালের গতিকে স্তব্ধ
করতে সক্ষম হয়েছে! সাবেকীয়ানা
ও বনেদীয়ানার মূর্তমান প্রতীক হয়ে আজও
ছায়াসুনিবিড় রামচন্দ্রপুরে সবার উপরে মাথা
তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে!
কৃতজ্ঞতা
স্বীকারঃ
তথ্য ও চিত্রঃ শ্রীযুক্ত
পিনাকী মুখার্জ্জী (পরিবারের সদস্য)
সংগ্রহঃ
শ্রীমান শঙ্খ
No comments:
Post a Comment