আজ শুভ নববর্ষ।
"বনেদীর-বনেদীয়ানা" পরিবারের সকল সদস্যকে এবং
শুভানুধ্যায়ীদের জানাই নতুন বছরের
অনেক অভিনন্দন এবং শুভকামনা।
আজ নতুন বছরে বনেদীয়ানার
পরিবারের সদস্যরা বিশেষ কিছু প্রতিবেদন
নিয়েই আলোচনা করবে।
প্রথম প্রতিবেদনটি পরিবারের গুরুত্বপূর্ন সদস্যা শ্রীমতী দেবযানী
বসু মহাশয়ার। আলোচনায়
আজ- পয়লা বৈশাখে- কালীঘাট
পয়লা বৈশাখঃ কালীঘাট
মন্দির
প্রতিবছরই
বাঙালির কাছে বাংলা বছর
শুরুর দিনটি বিশেষ তাৎপর্যময়। পয়লা
বৈশাখ মানেই নতুন জামাকাপড়,
প্রণাম, মিষ্টিমুখ, হালখাতা পুজো, রকমারি খাওয়াদাওয়া। এই
সমস্ত নিয়েই নববর্ষের শুভ
সূচনা হয় উৎসব মুখোরিত
দিনটিকে নিয়ে। নববর্ষ
মানে অনেক কিছু।
নববর্ষ মানে নতুন আশা,
পুরোনোকে ঝেড়ে ফেলে নতুনের
আকাঙ্ক্ষায় বুক বাঁধা।
আগের বছরের তুলনায় এবছর
যেন শান্তি ও সমৃদ্ধির
মুখ দেখা যায়, এমনটাই
আশা থাকে প্রত্যেকের মনে। যাঁর
যেমন জীবনযাত্রা তেমন ভাবেই পালন
করেন তিনি নববর্ষের দিনটি। এদিন
থেকে দিনপঞ্জী মেনে শুরু হয়ে
যায় সারা বছরের পরিকল্পনা। কাজের
সুবাদে ইংরাজি ক্যালেন্ডার মেনে
চলতে হলেও বাঙালির সামাজিক
জীবনে কিন্তু বাংলা বছরের
গুরুত্বই বেশি। নানান
পার্বণ, পুজো, বিয়ে, উপনয়ন,
অন্নপ্রাশন, উপবাস ইত্যাদি আবর্তিত
হয় বাংলা বছরের পঞ্জী
মেনেই।
পয়লা বৈশাখ আসবে
আর পুজো হবে না
তাই কি হয়! মাতৃভক্ত
বাঙালি তাই ছুটে আসেন
মা কালীর চরণে।
বাংলার মহাতীর্থ কালীঘাটে সেদিন উপচে-পড়া
ভিড়। সবাই
মনোকামনা পূরণের আশায় মাকে
নিবেদন করেন ভক্তির অর্ঘ্য। গ্রীষ্মের
প্রখর দাবদাহ উপেক্ষা করে
দীর্ঘ লাইন দিয়ে পুণ্যার্থীরা
পুজো দেন। সবার
মনে একটাই কামনা- মা
যেন পরিবার-পরিজনকে ভালো
রাখেন, ভালোয় ভালোয় কাটে
যেন বছরটি।
কালীঘাট মন্দির কমিটি জানাচ্ছে,
প্রতি বছরই যথেষ্ট ভীড়
হয় পয়লা বৈশাখে।
তবে দিনে দিনে ভিড়
বাড়ছেই। বিশেষ
পুলিশ বাহিনী দিয়ে সামলাতে
হয় ভিড়। বাঁশের
ব্যারিকেড করে দেওয়া হয়
গেট থেকে গর্ভগৃহে ঢোকার
দরজা পর্যন্ত। নিরাপত্তার
কারণে প্রতি গেটে মেটাল
ডিটেক্টার, বডি চেক-আপের
ব্যবস্থা থাকে। মহিলা
পুলিশও থাকেন প্রচুর।
কালীঘাট টেম্পেল কমিটি, কাউন্সিল অব
সেবায়েত ও পুলিশের যৌথ
মিটিংএ কার্যকরী বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
মন্দিরে পুজো দিতে এসে
ভক্তদের যেন কোনও অসুবিধে
না হয়, এজন্য নেওয়া
হয় নানান ব্যবস্থা।
সেবায়েতদের ব্যাজ দেওয়া হয়। মন্দিরের
ভিতরের ডালার দোকানগুলিতেও ব্যাজ
দেওয়া হয়। থাকে
পানীয় জল, ফার্স্ট এড
ও অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা। দীর্ঘসময়
লাইনে দাঁড়িয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ার
ঘটনা প্রতিবারই ঘটে কালীঘাটে।
পয়লা বৈশাখের আগের
দিন মায়ের মন্দিরের দরজা
খুলে যায় রাত ১টায়। চৈত্রসংক্রান্তি
ছেড়ে গেলেই মঙ্গলারতি দিয়ে
শুরু হয়ে যায় নববর্ষের
পুজো। রাত
বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভক্তদের
ভিড় বাড়তে থাকে।
চলতে থাক ডালাপুজো।
সাধারণ লাইনের সঙ্গে থাকে
ভি-আই-পিদের লাইন। সেখানে
সেবায়েতদের বিশেষ পরিচিতি লোকেরাই
জায়গা পান। নববর্ষের
সারা দিনটাই মা এভাবে
পুজো নেন। রাত
১১টার পর বন্ধ হয়
মন্দিরের দরজা। দ্বিপ্রহরে
একবারই ভোগরাগের জন্য বন্ধ থাকে
মন্দির।
নববর্ষের দিন আমরা যেমন
সাজি নতুন সাজে, মা
কালীকেও সাজানো হয় রাজবেশে। নতুন
বস্ত্র, ফুলের সাজ, গোলাপ-জল, আতর ইত্যাদি
দিয়ে মায়ের অঙ্গরাগ করিয়ে
দেন সেবায়েতরা। মাকে
এই রূপে দেখে তৃপ্তি
পান ভক্তরা। ভোগের
আয়োজনেও থাকে বিশেষত্ব।
দুপুরের ভোগে থাকে খিচুড়ি,
সাদাভাত, পোলাও, পাঁচ রকমের
ভাজা, তরকারি, নানারকম মাছ, বলির মাংস,
চাটনি, পরমান্ন ইত্যাদির ব্যবস্থা থাকে। শীতলভোগে লুচি,
মিষ্টান্ন থাকে। অনেক
ভক্তরাও এদিনের ভোগের ব্যবস্থা
করে থাকেন। কোন
কোন দিন অমাবস্যার সময়
ভোগের ব্যবস্থা করেন পালাদাররা; দরিদ্রভোজনও
কালীঘাটের পুজোর একটি অঙ্গ। প্রতিদিনের
সংখ্যা ৫০-৬০ থেকে
১৫০-২০০ পর্যন্তও হয়। তাঁর
পাত পেড়ে খান মন্দির
চত্বরে। বলিদানও
কালীঘাটের এক বিশেষত্ব।
প্রতিদিনের মতন মন্দির কমিটির
তরফ থেকে একটি ছাগবলি
দেওয়া হয়। সেটিই
এইদিনের প্রথম বলি।
এরপর ভক্তদের মানত করা বলি
শুরু হয়। প্রতিবছর
পয়লা বৈশাখে একশো ছাড়িয়ে
যায় বলির সংখ্যা।
কালীঘাটে পয়লা বৈশাখে সবচেয়ে
ভিড় হয় খাতাপুজোর জন্য। ব্যবসায়ীরাই
মূলত আসেন নতুন বছরের
খাতা মায়ের পায়ে ছুঁয়ে
আশীর্বাদ নিতে। বাঙালিরা
তো বটেই অবাঙালিরাও আসেন
এইদিনে, চলে গনেশ ও
লক্ষ্মীদেবীর পুজো। হাতের
খাতায় লাল কুমকুম, হলদির
ছাপ। সিঁদুর
দিয়ে আঁকা স্বস্তিক
চিহ্ন। একটা
করে কয়েন সিঁদুর রঞ্জিত
করে খাতায় মোহর লাগিয়ে
দেন সেবায়েতরা। বিনিময়ে
নেন দক্ষিণাও। ব্যবসায়
বাড়বাড়ন্তের আশায় মা দক্ষিণাকালীর
আশীর্বাদ নিয়ে শুরু হয়
নতুন খাতা।
কেন কিসের আশায়
আসেন এদিন ব্যবসায়ীরা কালীঘাটে?
দেখা হল ঠাকুরপুকুরের কাপড়-ব্যবসায়ী অমলকান্তি সাহার সঙ্গে।
পুজো দিয়ে চোখে-মুখে
ভক্তি আর তৃপ্তি নিয়ে
বেরিয়ে এলেন মন্দিরের গর্ভগৃহ
থেকে। তাকে
প্রশ্ন করায় তিনি বললেন,
ভোর পাঁচটায় লাইন দিয়ে বেলা
দুটোর সময় ঢুকেছি মন্দিরে। লাইন,
ধাক্কাধাক্কি তো থাকবেই, মাকে
বলেছি দোকানটা আরও বড় করতে
চাই। দেখো
এবছর যেন সেটা করতে
পারি।
এইভাবে বিভিন্ন ভক্তের
এদিন বিভিন্ন আশা বলতে আসেন
মাকে, মা যেন সবাই
ভালো থাকে। পয়লা
বৈশাখের এই ভক্তির আবেগ
সবার মধ্যেই দেখা যায়। নাটমন্দিরের
পাশে এক অবাঙালি ব্যবসায়ী
লাড্ডু বিলোচ্ছেন সবাইকে। বড়বাজারে
লোহার কারবার তাঁর।
দোকান শুরু সময় থেকে
প্রতিবছরই আসছেন মায়ের কাছে
পুজো দিতে পয়লা বৈশাখের
দিন। মায়ের
কাছে এবার বলেছেন মা
যেন ব্যবসার উন্নতি হয়, সবাইকে
ভালো রেখো তুমি।
তাই বছর শুরুর
দিনটি সবার যেন ভালো
কাটে এই প্রার্থনা করি
মায়ের কাছে। দেবযানী
বসুর লেখা দিয়ে শুরু
হল সেই শুভকামনার প্রার্থনা। সবাই
ভালো থাকুন।
তথ্যসূত্রঃ
শ্রীমতী দেবযানী বসু
No comments:
Post a Comment