Saturday, April 27, 2019

নাড়াজোল রাজবাড়ী-পশ্চিম মেদিনীপুর


ঐতিহ্যের ইতিহাসপর্বঃ 
আজ আবারও নাড়াজোল রাজবাড়ির দ্বিতীয়পর্ব, লিখলেন গুরুত্বপূর্ন সদস্য শ্রীমান্ শঙ্খ বনেদীয়ানা' এই দ্বিতীয়পর্বে আরও ইতিহাস পাওয়া যাবে, ঐতিহ্যের ঠিকানা পশ্চিম মেদিনীপুর
নাড়াজোল রাজবাড়ী পশ্চিম মেদিনীপুর


#প্রথম_পর্বের_লিঙ্ক
https://www.facebook.com/2300280956875219/posts/2342622019307779/

#দ্বিতীয়_পর্ব
অবিভক্ত বঙ্গদেশ তথা ভারতবর্ষের পরাধীনতার প্রাক্কালের ইতিহাস ঘাঁটলে নাড়াজোলের উল্লেখ প্রথম পাওয়া যায় ১৭৬০ সালে ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধে সিরাজুদ্দৌলাকে পরাজিত করে বাংলার বিশ্বাসঘাতক মিরজাফরের কাছ থেকে রবার্ট ক্লাইভ দুই ২৪ পরগণার জমিদারী ১৭৬০ সালে মিরজাফরের সঙ্গে মনোমালিন্যের কারণে, তাকে গদিচ্যুত করে ক্লাইভ মীরকাসেম(মিরজাফরের জামাতা)-কে নবাবের পদে বসান এর বিনিময়ে রবার্ট ক্লাইভ মীরকাসেমের থেকে বর্ধমান, মেদিনীপুর চট্টগ্রামের জমিদারী বছরই অক্টোবর মাসে পূর্বোক্ত তিনটি জায়গার সনদ নবাবের তরফ থেকে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানিকে আনুষ্ঠানিক ভাবে দান করা হয় এরই সাথে সাথে স্বাধীন নাড়াজোল রাজত্বের অবলুপ্তি ঘটে এত কিছু সত্ত্বেও ইংরেজ পদদলিত বঙ্গদেশের যে কয়েকজন রাজন্য নিজেদের স্বকীয়তা বজায় রেখে স্বতন্ত্রতা "রাজ" পদমর্যাদায় বরাবর কীর্তির আসন দাবী করে গেছেন, তাঁদের মধ্যে নাড়াজোল খান পরিবারের নাম প্রথমদিকে মেদিনীপুর বর্ধমান মিলিয়ে সর্বমোট ৫৮টি পরগণার সুবেদারী তথা জমিদারী ইংরেজদের হাতে আসে এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বর্ধমান মহিষাদল রাজপরিবারের পরেই নাড়াজোল "রাজপরিবারের" স্থান যদিও আনুষ্ঠানিক ভাবে "রাজা" উপাধিতে এই পরিবারকে ভূষিত করা হয় আরও অনেক পরে
যাইহোক, পূর্ববর্তী পর্বের সূত্র ধরেই আলোচনায় আসা যাক ১৮৩০ সালের মার্চ মাসে মোহনলাল খানের মৃত্যুর পরে নাড়াজোল 'খান'-পরিবারে এক সাংঘাতিক অন্তর্দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয় জমিদারীর আসনে কোন যোগ্য উত্তরসূরীকে বসানো হবে, সে নিয়ে সুদীর্ঘ টালমাটাল পরিস্থিতি কাটিয়ে আনুমানিক ১৮৫০ সাল কি তার আগে-পরের সময়ে জমিদারীর আসনে বসেন মহেন্দ্রলাল খান শাসনভারের কাজে নেমে প্রথমদিন থেকেই মহেন্দ্রলাল একজন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন জনহিতৈষী ভূস্বামীর পরিচয় দে' ব্রিটিশ শাসনের অধীনে থেকে এবং ইংরেজকুলের সঙ্গে মার্জিত সদ্ভাব বজায় রেখেও নিজের বিচক্ষণতার জোড়ে দেশীয় কৃষ্টি সংস্কৃতির প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকরূপে বরাবরই একজন স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বের ছাপ রেখে গেছেন ১৮৮৭ খ্রীস্টাব্দের ফেব্রুয়ারীতে ইংল্যান্ড অধিশ্বরী ভিক্টোরিয়ার 'জুবিলি উৎসব' উপলক্ষ্যে ইংরেজ সরকারের তরফ থেকে তাঁকে 'রাজা' উপাধিতে ভূষিত করা হয় প্রায় চল্লিশ বছরেরও বেশী সময়কাল ধরে "জমিদারী" তথা "রাজত্ব" সামলানোর পরে ১৮৯২ খ্রীস্টাব্দের জানুয়ারীতে মহেন্দ্রলাল হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পরলোক গমন করেন

পিতার পরলোক গমনের পরে নাড়াজোলের অধীশ্বর হয়ে বসেন পুত্র নগেন্দ্রলাল প্রজাপালক হিসাবে এবং 'ভূস্বামী' শব্দের একজন প্রত্যক্ষ পরিচয়বাহী রূপে নগেন্দ্রলাল ব্রিটিশ সরকারের দৃষ্টিতেও এক জ্বলন্ত উদাহরণ রেখে যান নানাপ্রকার জনহিতকর সমাজকল্যাণমূলক কাজের সুবাদে রাজত্বে আসীন হবার মাত্র তিনবছরের মধ্যেই, ১৮৯৫ সালের নভেম্বরে তৎকালীন বঙ্গদেশের ব্রিটিশ শাসক প্রতিনিধি কর্তৃক "মহারাজা" সম্মানে সম্মানিত '
কিন্তু বিদেশী 'লালমুখো'-দের নজরে নিজের 'মহারাজ সুলভ' ব্যক্তিত্ব বেশীদিন ধরে রাখতে পারেননি নগেন্দ্রলাল স্বদেশী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে নগেন্দ্রলাল খান এক চিরস্মরণীয় নাম পরাধীন ভারতমাতার বৈদেশিক শৃঙ্খলামুক্তির জন্য প্রচুর অর্থব্যয় করেন তিনি তাঁর প্রত্যক্ষ সহযোগিতা পৃষ্ঠপোষকতায় একদা মেদিনীপুরের "গুপ্ত সমিতি"- কার্যকলাপ সারা বাঙলায় সাড়া ফেলে দেয়! সমিতির কার্যকারী বিভাগের কর্তাব্যক্তিগণ, যথাঃ 'মহারাজ' নগেন্দ্রলাল খান, জ্ঞানেন্দ্রনাথ বসু, হেমচন্দ্র কানুনগো প্রমুখের নেতৃত্বে বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে ১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোবর নাড়াজোল, ক্ষীরপাই মেদিনীপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে 'অশৌচ দিবস' পালিত হয় সেই থেকেই ইংরেজ সরকারের নজরে নাড়াজোলের নরপতি একজন ব্রিটিশবিরোধী প্রতিনিধিত্বের মূর্তমান প্রতীকে রূপান্তরিত ' তাঁর উপরে বরাবরই ইংরেজদের সজাগ দৃষ্টি বজায় থাকতো ১৯০৮ সালের আগস্ট মাসে মেদিনীপুর বোমা মামলায় নিজ বসতবাটী থেকেই নগেন্দ্রলালে গ্রেপ্তার করা হয় সেই সময়ে মামলা চলাকালীন তাঁকে "Condemned Cell"- রাখার ব্যবস্থা করা হয় যদিও উপযুক্ত সাক্ষী এবং প্রমাণের অভাবে শেষপর্যন্ত ইংরেজ প্রশাসন নগেন্দ্রলাল'কে ছেড়ে দিতে বাধ্য ', তবুও তাঁর থেকে ব্রিটিশবিরোধী তথ্য জানার চেষ্টায় বন্দীদশা চলাকালীন অকথ্য অত্যাচার করা হয় তাঁকে এবং ছেড়ে দেওয়ার পরে "মহারাজ" উপাধিও কেড়ে নেওয়া হয় একতরফা নজরবন্দী হয়ে থেকেও যতদিন নগেন্দ্রলাল জীবিত ছিলেন, ততদিনই বিভিন্নভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে যথাসাধ্য সাহায্য করে গেছেন ১৯২১ সালে এই দেশপ্রেমী "মহারাজা" পরলোক গমন করেন

এরপরে নাড়াজোলের অধিপতি ' দেবেন্দ্রলাল খান, জন্মঃ ১৮৯৩ সালে দেবেন্দ্রলাল ১৯২৬ সালে মেদিনীপুর বোর্ডের সভাপতি নির্বাচিত ' ১৯২৮ সালে জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে মোতিলাল নেহেরুর সভাপতিত্বে কোলকাতায় অধিবেশন আয়োজিত হয় সেই সময়ে মোতিলাল নেহেরু এই নাড়াজোল রাজবাড়ী থেকেই অধিবেশনে যোগ দিয়েছিলেন অধিবেশনে 'নেহেরু রিপোর্ট' নিয়ে প্রবল বাদানুবাদ হয় এবং একপর্যায়ে মহাত্মা সুভাষচন্দ্র বসু পূর্ণ স্বাধীনতার দাবী তোলেন ১৯৩০-এর ২৬শে জানুয়ারী সারাদেশের সঙ্গে নাড়াজোল রাজবাড়ীতেও ভারতের জাতীয় পতাকা উত্তোলিত হয় ১৯৩৮ সালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কমিটির কার্যসমিতি গঠিত হলে সুভাসচন্দ্র বসু মেদিনীপুর বোর্ডের সভাপতি নির্বাচিত ' তখন ঘাটাল মহকুমাকে কেন্দ্র করে '৩৮ সালের ১৭ এবং ১৮ই মে তিনি বেশ কয়েকটি সভার আয়োজন করেন ১৯৩০ থেকে ১৯৪০ অব্দি দেবেন্দ্রলাল খান ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে ছিলেন এই দীর্ঘসময়ে তিনি 'গুপ্ত সমিতি'- সভাপতিত্বের আসনে বসে বহু জনসভা করেন তাঁর চিন্ময় বাচনভঙ্গিমা উদ্দীপ্ত কণ্ঠস্বর সমিতির সংগ্রামীদের এতটাই প্রভাবিত করে যে, তৎকালীন মেদিনীপুরের তিনজন কুখ্যাত ম্যাজিস্ট্রেট 'বারজ', 'পেডি' এবং 'ডাগলস'-কে বেঘোরে প্রাণ দিতে হয়!
স্বাধীনতা আন্দোলনের সূচনালগ্নে পরোক্ষভাবে এবং পরবর্তীতে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পরা নাড়াজোল রাজপরিবারের তহশিলদারের ভূমিকায় একসময়ে কাজ করতেন ত্রৈলোক্যনাথ বসু শহিদ ক্ষুদিরাম বসু' পিতা সেই সূত্রে অনেক অল্পবয়স থেকেই ক্ষুদিরামের অবাধ যাতায়াত ছিলো রাজবাড়ীতে রাজবাড়ীর অন্দরমহলে কোন অংশে বিপ্লবীদের গোপন আস্তানা ছিলো বা তাঁদের পর্যায়ক্রমিক কার্যকলাপের সব খবরাখবরই শুনতেন ক্ষুদিরাম সেই থেকেই তিনি উদ্দীপিত ' এবং ভারতমাতার চরণে হাসতে হাসতে নিজেকে উৎসর্গ করেন

নাড়াজোল রাজবাড়ীর অন্দরেই চলতো বিপ্লবীদের অস্ত্রপ্রশিক্ষণ বোমাবাঁধার কর্মকাণ্ড এসবের পরিচালনায় হেমচন্দ্র কানুনগো থেকে শুরু করে ঋষি অরবিন্দ ঘোষ, বারীন্দ্রকুমার ঘোষ প্রমুখ বহু মহাপ্রাণের পদধূলি পড়েছে এই রাজবাড়ীতে
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তথা বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামও বহুবার এসেছেন এখানে দেবেন্দ্রলালের সঙ্গে রবিকবির বিশেষ হার্দিক সম্পর্ক ছিলো ১৯২৫ সালে গান্ধিজী' 'অস্পৃশ্যতা বিরোধী সভা'- আয়োজনও এই রাজবাড়ীতেই অনুষ্ঠিত হয়েছিলো বহু পটপরিবর্তন, উত্থানপতনের পরে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা লগ্নে যে কয়েকজন ভারতীয়'কে "দেশভক্তি"- জন্য বিশেষ সম্মান দেওয়া হয়েছিলো, নাড়াজোল অধীশ্বর দেবেন্দ্রলাল খান তাঁদের মধ্যে অন্যতম এনার মৃত্যুর পরে আর মাত্র একজনই এই রাজপরিবারের তরফ থেকে বিশেষ কৃতিত্ব স্থাপন করে যান তিনি খান বংশের পুত্রবধূ স্বর্গীয়া অঞ্জলী খান স্বাধীন ভারতবর্ষের মেদিনীপুরে পাঁচবার জাতীয় কংগ্রেসের তরফ থেকে বিধায়ক পদে নির্বাচিত ' নারীশিক্ষার প্রসারে তাঁর অবদান মেদিনীপুরবাসীর কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে নাড়াজোল রাজবাড়ীর একটি বিরাট অংশ এবং নাড়াজোল অধিকৃত 'গোপ' রাজবাড়ী জুড়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন মহিলা(গোপ) কলেজ নাড়াজোল মহাবিদ্যালয় এছাড়াও সমগ্র মেদিনীপুরে রাজবধূ তথা বিধায়ক অঞ্জলী খানের দানধ্যানের হিসাবনিকাশ ধারণাতীত! ২০০৫ সালে কোলকাতাস্থিত বাসভবনে এই মহীয়সী' তিরোধান ঘটে; সঙ্গে অস্তমিত হয় সুদীর্ঘ ৫৮১বছর(২০০৫ সালের হিসাব অনুযায়ী)-এর গৌরবোজ্জ্বল পটভূমির যবনিকা পতন ঘটে!
আজ নাড়াজোল রাজবাড়ী'কে আর রাজবাড়ী বলা যায়না ধ্বংসাবশেষ বৈ আর কিচ্ছু নেই সেখানে সেখানে এখনও যেন চারদেওয়ালের মধ্যে লুকিয়ে আছে আভিজাত্যের সৌরভ, সনাতন ধর্মের পবিত্রতা, দেশমাতৃকার প্রতি আত্মবলিদানের অঙ্গিকার হয়তো কান পেতে স্মৃতিমেদুরতায় ডুব দিলে শোনা যাবে নেতাজীর সেই দৃপ্ত কণ্ঠস্বর, "আপনারা প্রস্তুত থাকুন খুব শীঘ্রই ভারতবর্ষের স্বাধীনতাপ্রাপ্তি ঘটবে"  পরবর্তীকালে শরিকি ঝামেলা, উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি-বন্টন তথা অবাঞ্ছিত জমি অধিগ্রহণ ইত্যাদির মতো ন্যাক্কারজনক ব্যাপার এই রাজপরিবারের উপসংহার পর্যায়ে যুক্ত হয়েই গগনচুম্বী বৈজয়ন্ত'কে পানাপুকুরে ছুঁড়ে ফেলেছে!

নমস্কার
তথ্যসূত্রঃ শ্রীমান্ শঙ্খ


No comments:

Post a Comment