Friday, April 19, 2019

নন্দদুলাল- গুড়াপ, হুগলী


ঐতিহ্যের ইতিহাসপর্বঃ
আবারও এক নিরব ইতিহাসের সাক্ষী হলাম আমরা এবারে ইতিহাসের খোঁজে গ্রুপের সদস্য শ্রীমান শঙ্খ আজ আলোচনা করা হলো এক অমূল্য তথ্য সম্পর্কে

শ্রী শ্রী নন্দদুলাল গুড়াপ, হুগলী

কোন স্মরণাতীত লগ্নের ভৌগোলিক প্রেক্ষাপটে বর্তমান হুগলী জেলার ধনিয়াখালি অন্তর্গত গুড়াপ গ্রামের জন্ম হয়েছিলো, সে ইতিহাস আজ লুপ্ত কেমন ছিলো সেই পত্তনীর অধিবাসীরা, কীরকম ছিলো তাঁদের জীবনযাত্রা সেসব আজ গবেষণার জন্য অপেক্ষারত তবে গুড়াপ সম্পর্কে যাকিছু প্রাচীন দলিল-দস্তাবেজ পাওয়া গেছে এখনও পর্যন্ত, তা'থেকে জানা যায় এই অঞ্চল একাময়ে বর্ধমান মহারাজাদের অধীনে ছিলো এখানকার বিলুপ্তপ্রায় অতীতের স্মারকগুলির দিকে তাকালে বোঝা যায়, মধ্যযুগের কনো একসময় থেকে দেবদেউল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এই গ্রাম সন্নিহিত অঞ্চলকে সুগঠিত করার প্রয়াস চালানো হয়েছিলো

ইংরেজ আমলের ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায়, প্রাথমিকভাবে যে সময়ে বেঙ্গল প্রভিন্সিয়াল রেলপথই কোলকাতার সঙ্গে বর্ধমানের যোগাযোগমাধ্যম কাজ করতো, তখন গুড়াপ অঞ্চলটি "গুড়ুপ" নামে সংযুক্ত ছিলো এই নামকরণের প্রকৃত ইতিহাস কী, সেটির প্রমাণ আজ লুপ্ত তবে গুড়াপের মধ্যযুগীয় অবস্থান লক্ষ্য করলে কিছুটা সংশয় দূর হয় একদা গুড়াপের একদিকে বিখ্যাত সপ্তগ্রাম অন্যদিকে বৈষ্ণবতীর্থ কুলীনগ্রামের উপস্থিতি; কাছাকাছি জৌগ্রাম(এককালিন জৈনতীর্থ, বর্তমান শৈবক্ষেত্র জটেশ্বর) বালিদহের কোলঘেঁষে কোনোএক লুপ্ত নদীপথে যাতায়াতের অতি সুবিধাজনক স্থান ছিলো গুড়াপ ভৌগোলিক কারণে অধুনাবিলুপ্ত কোনো এক গঙ্গাভিমুখী নদ/নদীর পরিত্যক্ত নদীখাত, পালযুগের বিভিন্ন প্রস্তরমূর্তি, নৌকার ভাঙা মাস্তুল ইত্যাদিই প্রমাণ দেয় এককালে নদীর পার্শ্ববর্তী বিশ্রামের স্থান হিসাবে আদৃত হতো বর্তমান গুড়াপ তৎকালীন লৌকিকতা অনুযায়ী, এখানকার অধিবাসীরা 'গুড়' এবং 'জল'(অপ) দিয়ে; মতান্তরে 'গুড়' এবং 'অপূপ'(পীঠা) দিয়ে বিশ্রামরত নৌকাযাত্রীদের আপ্যায়ন জানাতেন হয়তো, সেই আপ্যায়নের সামগ্রীই লোকমুখে প্রচারিত হতে হতে, আজকের "গুড়ুপ"/গুড়াপ" নামের সৃষ্টি


বাঙলার নবাব তখন আলিবর্দী খাঁ(১৭৪০খ্রীঃ- ১৭৫৬খ্রীঃ) নবাবের অধীনে বহু রাজন্যবর্গের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বর্ধমান মহারাজাধিরাজ তিলকচাঁদ মোহতাব বাহাদুর গুড়াপের অধিবাসী রামদেব নাগ ছিলেন বর্ধমানরাজের প্রতিরক্ষা বিভাগের একজন দায়িত্বশীল কর্মচারী এই গ্রামকে ঘিরেই তিনি এক গড় তৈরী করে প্রতিরক্ষাবাহিনীর আস্তানা বানিয়েছিলেন
রাজবংশের ইতিহাসের পাতা থেকে জানা যায়, রামদেব নাগ মশাই গুড়াপের নন্দদুলাল জিউয়ের মন্দিরটি তৈরী করান ১৭৪৯ খ্রীস্টাব্দে মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করেন কোষ্টিপাথরের শ্রীকৃষ্ণ, গোপাল অষ্টধাতুর শ্রীরাধিকা বিগ্রহ মন্দিরগাত্রে পোড়ামাটির টেরাকোটা, রিলিফ, ফ্রেস্কো, পঙ্খের কাজ রীতিমতো প্রশংসার দাবিদার আজও এই মন্দিরের অমর শিল্পকীর্তি দেখার জন্য দূরদূরান্ত থেকে বহুজন আসেন


রামদেব নাগ মশাই যে শুধু নন্দদুলালের মন্দিরটিই তৈরী করিয়েছিলেন, তা নয় প্রচুর অর্থব্যয় করে, মন্দির সংলগ্ন নাটমন্দির, রাসমঞ্চ, দোলমঞ্চ বিভিন্ন জায়গায় সবশুদ্ধ একশোআট'টি শিবমন্দিরও স্থাপন করান
একসময়ে মাহরাজের কানে এই খবর গিয়ে পৌঁছায় তিনি ভাবেন, রামদেব নিশ্চয়ই রাজকোষের অর্থ তছরুপ করে, এসব কাণ্ড ঘটাচ্ছেন তাই সাময়িকভাবে রামদেবকে নজরবন্দী করান পরে যখন জানতে পারেন যে, রাজকোষের অর্থ না নিয়ে, নিজের প্রচেষ্টায় এসব তৈরী করানো হয়েছে, তখন ধর্মপ্রাণ মহারাজ রামদেবকে মুক্ত করেন এবং এই মন্দিরগুলির নিত্যসেবা, রাস, দোল প্রভৃতি অনুষ্ঠানের জন্য প্রচুর ভূসম্পত্তি দান করেন সেইসাথেই মহারাজের একান্ত ইচ্ছায় দীপান্বিতা অমাবস্যার পরদিন শ্রীমন্দিরে অন্নকূট মহোৎসবের সূচনা হয় রাজদত্ত সম্পত্তির আয় থেকেই একটা সময় অব্দি নন্দুদুলাল একশোআট শিবের সেবা-ভোগ-রাগ হয়ে এসেছে


আজ আর সেই ভূসম্পত্তি নেই মেরেকেটে, পনেরো/ষোলোবিঘা জমি বর্তমান তা দিয়েই কোনোরকমে, ঠাকুরসেবা মন্দির রক্ষণাবেক্ষণ হয়ে থাকে একটি সেবায়েত সমিতির হাতে বর্তমানে মন্দির পরিচালনার যাবতীয় দায়িত্ব ন্যস্ত তবে, এলাকার মানুষ সারাবছর ধরে অপেক্ষা করেন অন্নকূট মহোৎসবের জন্য তখন মন্দির কর্তৃপক্ষ জনসাধারণের যৌথ উদ্যোগে অনুষ্ঠান পরিচালিত হয়
সুউচ্চ মন্দিরের নাটমন্দিরটি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় রামদেব নাগের বংশধর স্বর্গীয় করুণাময় নাগ মশাই রামদেব নাগ যে মহৎকীর্তি স্থাপন করে গেছিলেন, তার উত্তরাধিকার বহন করতে এই বংশে জন্ম হয় আরেক বিখ্যাত মহাপ্রাণের, ভারতের গণিতশাস্ত্রের অন্যতম বিখ্যাত গণিতজ্ঞ স্বর্গীয় কেশবচন্দ্র নাগ
একসময়ে এই মন্দিরে বেশ কয়েকজন বৈষ্ণব মহাত্মার পদধূলিও পড়েছে সে তালিকায় বৈষ্ণবাচার্য্য রামদাস বাবাজী চরণদাস বাবাজী অন্যতম

এককালের উৎসবমুখরিত মন্দিরপ্রাঙ্গণ এখন সুনসান দিনের নির্দিষ্ট সময়ে শুধু পালাদার সেবায়েতরা আসেন বিগ্রহদের সেবা করতে বিশেষ বিশেষ তিথিতে বা পূজো উপলক্ষ্যে ভীর হয় যদিও, তবে সারাবছরই প্রায় ফাঁকা থাকে মন্দির অন্নকূটের সময়ে একশোআট রকমের ব্যঞ্জনসহ অন্নভোগ নিবেদনের নিয়ম ছিলো একসময়ে এখন অার্থিক অসচ্ছলতার কারণে সেসব কমিয়ে দেওয়া হয়েছে অন্নকূট ছাড়াও রাস দোল উপলক্ষ্যে যথেষ্ট ভক্তসমাগম হয়, পালাকীর্তনের আসর বসে, যথাসাধ্য বসিয়ে ভোগ খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা হয় শিবমন্দির গুলিকে কেন্দ্র করে শ্রাবণ-চৈত্রমাসে ছোটোখাটো অনুষ্ঠান, গাজন, চরক ইত্যাদির আয়োজন হয়
একটা সময় পরে কালের নিয়মে নন্দদুলাল শিবমন্দিরগুলির টেরাকোটার কাজগুলি নষ্ট হতে থাকে ১৯৮০ সালে ভারত সরকারের তরফ থেকে মন্দিরে কিছু সংস্করণও হয় তবে সেটা মোটেই যথেষ্ট নয় রোদ-ঝড়-বৃষ্টির দাপটে শতাব্দীপ্রাচীন মন্দির স্বাভাবিক নিয়মেই ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকবে তার জন্য আরও পাকাপোক্ত ব্যবস্থা নেওয়া দরকার অন্তত বিষ্ণুপুর বা আঁটপুরের সমগোত্রীয় গুড়াপের এই নন্দদুলাল একশোআট শিবমন্দিরের ক্ষেত্রে সরকারি তরফে রক্ষণাবেক্ষণের নজির নিতান্তই ফিকে!
পরিচর্যার অভাবে হয়তো এগুলিও অদূর ভবিষ্যতে ধ্বংসাবশেষ ছাড়া আর কোনো কিছুরই তকমা পাবে না!
তথ্যসূত্র এবং চিত্রঃ শ্রীমান্ শঙ্খ


No comments:

Post a Comment