ইতিহাসের ঐতিহ্য এবং ঐতিহাসিক
দৃষ্টিভঙ্গি অতীত-বর্তমান এবং
ভবিষ্যতের যোগসূত্র। "বনেদীর-বনেদীয়ানা"
পরিবারের উদ্দেশ্য শুধুমাত্র পুজো কেন্দ্রিক নয়
তার সাথে প্রাচীন মন্দির,
স্থাপত্য এবং ঐতিহ্যপূর্ণ বিষয়ে
গবেষণাই মূল লক্ষ্য।
তাই আজ কলকাতার এক
অন্যতম ঐতিহাসিক স্থানের সংক্ষিপ্ত ইতিহাসই তুলে ধরা হল। এই
গবেষণার প্রথমপর্ব প্রকাশিত হল সংক্ষেপে।
প্রকাশ করলেন শ্রীমান্ শুভদীপ
রায় চৌধুরী।
রবার্ট ক্লাইভের বিজয়
অভিযানের পর থেকে কলকাতার
নিস্তরঙ্গ তটরেখামূলে আঘাত করেছে বিবর্তনের
অজস্র ঢেউ। শ্বাপদসঙ্কুলে
জঙ্গলাকীর্ণ কলকাতার আঁধার তপস্যা খান
খান হয়ে ভেঙে পড়েছে
পশ্চিমবঙ্গের আলোকবাহী সাম্রাজ্য পিপাসুর সৃজন উল্লাসে।
"রাইটার্স বিল্ডিং"-অফুরন্ত মর্যাদার আত্মসমাহিত যেন। কিন্তু
বাড়িটার এতবড় কৌলিন্য মর্যাদা
কতদিনের?? সেই সুদূর কাল
থেকে এই অট্টালিকার যেমন
ঘটেছে বাহ্যিক সংস্কার তেমনি ভেতরের ইতিহাসও
বদলে গিয়েছে বারবার।
কোম্পানির আমলে জুনিয়ার সিভিলিয়ান
কর্মচারীদের "রাইটার" নামে বলা হত। আরও
ভালো ভাবে বলতে গেলে
রাইটার বলতে কোম্পানির কেরানিদের
বলা হত। গোড়ার
দিকে বড়বড় কর্মচারীরা ব্যবসা
বুঝতেন। সামরিক
শিক্ষাও ছিল কিন্তু লেখাপড়ায়
সুপণ্ডিত ছিলেন তা বলা
যায় না। তাই
হিসাবপত্র রাখার জন্য কেরানিদের
রাখা হত। কিন্তু
তাদের আয়ত্তে রাখা মুশকিল
হয়েছিল, তাই ইষ্ট ইন্ডিয়া
কম্পানি তাদের নিজেদের তত্ত্বাবধানে
তাদের রাখতে শুরু করেন
এবং তাদের জন্য বসতবাড়িও
নির্মাণ করেন। যেহেতু
কেরানিরা থাকবে তাই বাড়িটার
নাম "রাইটার্স বিল্ডিং"। অবশ্য
রাইটার্স বিল্ডিংএর সূচনা অনেক আগে
থেকেই। যখন
জোব চার্ণক তার চারজন
লোক নিয়ে কলকাতায় পদার্পণ
করেন তখন তিনি বলেন
রাইটারদের জন্য মাটি এবং
খড় দিয়ে ঘর তৈরী
হবে(১৬৯০খ্রিঃ,১৬ই আগস্ট)।
দ্বিতীয় রাইটার্স বিল্ডিংএর সূচনা প্রাচীন ফোর্ট
উইলিয়াম সংলগ্ন কোন স্থানে। বর্তমানে
জিপিও এবং ফেয়ারলি প্লেসস্থ
পূর্বরেল দপ্তরের মধ্যবর্তী কোন স্থানে।
১৭৫৬ খ্রিঃ আচমকা
কলকাতা বিধ্বস্ত করে গেলেন নবাব
সিরাজদ্দৌল্লা। এরপর
পুরোনো দুর্গের জন্য ব্যয় বাড়ানো
হয়। কলকাতা
দখলের পর দপ্তরের কাজ
বেড়ে যাওয়ায় রাইটার্স বিল্ডিংএর
ভূখণ্ড খালি পড়ে ছিল
দেখে, রাইটারদের জন্য পাকা বসতবাড়ি
নির্মাণকল্পে ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি
জমি পাট্টা দিলেন টমাস
লায়নকে(১৭৭৬খ্রিঃ,১৮ই নভেম্বর)।
দুইখণ্ডে জমির পরিমান ১৬বিঘা,১৭কাঠা ৮ছটাক।
ওই পাকা দালানের নির্মাতা
হিসাবে টমাস লায়নের পরিচিতি
আছে রাইটার্স বিল্ডিংএর পিছনে "লায়নস্ রেঞ্জ" পথের
নামে।
১৭৭৭ খ্রিঃ মধ্যে
নতুনবাড়ি দখল করলেন রাইটাররা
এবং কাজ শেষ হল
১৭৮০ খ্রিঃ কিছুদিন পর। সেই
বছরই এই সম্পত্তি হস্তান্তরিত
হল হেস্টিংস কাউন্সিলের অন্যতম সদস্যের হাতে। বলাবাহুল্য
সেই বিল্ডিংএর সাথে এই দালানে
কোন সম্পর্ক নেই।
বিল্ডিংএর সর্বোপরি পাশাপাশি ১৬টি ঘর, বারান্দা
ও দুইপ্রান্তে কাঠের চওড়া সিড়ি,
লায়নস্ রেঞ্জের দিকে করিডোর দিয়ে
সংযুক্ত টয়লেট। এই
ছিল প্রথম অবস্থা, এরপর
ইংরেজ আমলে পরিবর্তিত হয়
পুরোনো কাঠামোর এবং তা বিশাল
আকারে রূপান্তরিত হয়। ১৭৭০-১৭৮০ খ্রিঃ এই
রাইটার্স বিল্ডিং সেকালের কলকাতার এক অন্যতম প্রাসাদ-সৌধ। ১৭৮৯
খ্রিঃ উইলিয়াম হকি তার "হিকিস
গেজেট"এ লিখেছেন- রাইটার্স
বিল্ডিং কলকাতার প্রথম তিনতলা অট্টালিকা। এতকাল
এই বিল্ডিং দেখতে ছিল অয়্যারহাউসের
মতন। ক্রমশ
সেই আকৃতির আমূল পরিবর্তন
ঘটে প্রায় ১৮২১সাল পর্যন্ত। সুন্দর
ব্যালকনি দেখা দিল সামনের
দিকে। মাঝখানের
কিছু অংশে কিছুকাল ফোর্ট
উইলিয়াম কলেজ ছিল, যেখানে
রাইটাররা পড়াশুনা করত। একতলায়
ক্লাস, দোতলায় চারটি ঘর
নিয়ে লাইব্রেরি আর তিনতলায় পরীক্ষার
ঘর। আশেপাশের
অংশে থাকতেন বাইশ জন
রাইটার ছাত্র। শুধুমাত্র
অবিবাহিতদের জন্য এই ব্যবস্থা
ছিল বিবাহিত কর্মচারীরা এখানে থাকতে পারতেন
না।
সেদিনের ডালহৌসি স্কোয়ার ও তার আশেপাশের
দৃশ্য আজ আর কল্পনাও
করা যাবে না।
একদিকে আদি গির্জা আর
অন্যদিকে মারহাট্টা ডিচ পরিবেষ্টিত প্রাচীন
দুর্গ। অদূরে
ছিল অট্টালিকার কেন্দ্রে সেদিনের থিয়েটারহল, যা ইংরেজদের একমাত্র
আনন্দনিকেতন।
"লালদিঘি"- কাছের কিংবা দুরের
মানুষের একমাত্র বেড়াবার জায়গা বা বল
যায় প্রাচীন কলকাতার এক অন্যতম স্থান। এই
লালদিঘির নামকরণ নিয়ে বহু
ঐতিহাসিক তথ্য রয়েছে এবং
তার বিতর্কও রয়েছে। তাই
সেই তথ্যের আলোচনা বা
গবেষণা এই প্রথম সংক্ষিপ্ত
পর্বে বর্তমানে নেই। ভবিষ্যৎএ
বহু ঐতিহাসিকের নানান তথ্যাবলি তুলে
ধরা হবে গবেষণার মাধ্যম
হিসাবে।
রাইটার্স বিল্ডিংএর মানমর্যাদা বহুগুন বেড়েছে কিন্তু
সেই প্রাকৃতিক পরিবেশ ঘুচে গেছে
তাতে কোন সন্দেহ নেই। প্রথম
পরিবর্তন-১৮৩৬সাল, লর্ড বেন্টিঙ্কের সময়কাল। নতুন
ব্যবস্থায় চলে গেলেন রাইটাররা,
শিক্ষাব্যবস্থা বন্ধ হল।
বিশাল সৌধ খালি পড়ে
থাকল বেশ কিছুকাল।
কিছুকাল পরে সরকার ভাড়া
দিলেন ব্যবসায়ীদের। এইভাবে
চলল প্রায় ৪১বছর।
১৮৭৭সালে স্যার অ্যাসলির সময়
সরকারি তরফ থেকে আবার
পুনরুদ্ধার করা হল।
মার্টিনের হাতে দিলেন সংস্কারের
ভার। ১৮৮০সালে
বাড়ির গায়ে পোড়ামাটির রঙের
প্রলেপ। দেখা
গেল কোরিন্থীয় ধাঁচের চেহারা।
সেই কৃত্তিম স্তম্ভগুলির ওপর ত্রিকোনী চূড়া। এই
সবের মদ্যে ফুটে উঠল
ভিক্টোরীয় রাজশক্তি আর নাগরিক দম্ভ। খোদাই
করা আছে নানান মূর্তি। বলাবাহুল্য
রাইটার্স বিল্ডিং কলকাতার ইতিহাসের সাথে অঙ্গাঙ্গি ভাবে
জড়িত। কলকাতার
প্রাচীনতম সময় থেকে আজ
বর্তমান সময়ের সমস্ত বিবর্তনের
সাক্ষী এই বিল্ডিং।
ইংরেজ আমলে বা তারও
আগে এই বিল্ডিংকে কেন্দ্র
করে বহু ঐতিহাসিক পর্যালোচনা
রয়েছে।
ইতিহাসের আলোচনা বা গবেষণায়
বহু ঐতিহাসিকের বহু তথ্যের ওপরই
গবেষককে নির্ভর করতে হয়। কখন
সাহিত্যগত উপাদান কখন প্রত্নতাত্বিক
উপাদান আবার কখনও মৌখিক
উপাদান। তাই
আজ প্রাথমিক আলোচনায় অতি সংক্ষেপে তুলে
ধরলাম এই বিল্ডিংএর ইতিহাস।
কৃতজ্ঞতাস্বীকারঃ শ্রী অশোক কুমার
রায় রচিত "ঠিকানা কলকাতাঃ ঐতিহ্যের
ঘরবাড়ি"
তথ্য সংগ্রহে এবং গবেষণায়ঃ শ্রীমান্
শুভদীপ রায় চৌধুরী
Picture Courtesy- Net
No comments:
Post a Comment