ঐতিহ্যের
ইতিহাসপর্বঃ
আজ বনেদীয়ানা'য়
প্রকাশিত হল আদিগঙ্গার ধারে
পুরোনো রাসবাড়ির ইতিহাস। লিখলেন
সদস্য শ্রীমান্ হৃত্বিক চক্রবর্তী মহাশয়।
কালীঘাট
মন্দির থেকে মনসামঙ্গল বর্ণিত
বেহুলার স্বর্গে যাওয়ার পথ ধরে
এগোতে থাকলে পুণ্যতোয়ার দুধার
জুড়ে দেখা যায় সহস্রাধিক
দেবগৃহ।তার
মধ্যে ঐতিহাসিক ও স্থাপত্যশৈলীর বিচারে
যেগুলি বিশেষ উল্লেখের দাবি
রাখে, তাদের মধ্যে বিশেষ
উল্লেখযোগ্য গোপীনাথ জীউয়ের সুদৃশ রাসমন্দিরটি।কিছুটা
পাশ্চাত্যশৈলীতে নির্মিত এই দেবালয়ে প্রথম
দীপশিখা প্রজ্বলনের ইতিহাসটা জানতে হলে আমাদের
পিছিয়ে যেতে হবে আজ
থেকে বছর শ'দুয়েক
আগে।
শীর্ণকায়া
আদিগঙ্গা তখনও টালিনালায় পরিণত
হননি।যাত্রী
ও পণ্যবাহী নৌকো বেশ স্বাচ্ছন্দ্যেই
চলাচল করে পতিতপাবনীর বুক
চিরে।নদীর
দু'ধারে সভ্যতার প্রতীক
হিসেবে সবে গড়ে উঠছে
বেশ কয়েকটা জনবসতি।দয়াময় দেবতার নামে
সকাল সন্ধ্যায় জয়ধ্বনি উঠছে অহরহ।সতীপীঠ কালিতীর্থে মা
মহামায়ার জন্য সাবর্ণ বংশের
আর্থিক সহায়তায় নির্মিত হয়েছে কালীঘাট মন্দির। lওই
একই সময়পর্বে আদিগঙ্গার দুকুল জুড়ে স্বর্গের
অন্যান্য দেবদেবীরাও নিজেদের আলয় নির্মাণে মন
দিলেন। কোথাও
জনার্দন, কোথাও কাশীনাথ, কোথাও
বা তিনি সিদ্ধেশ্বরী।
বৈষ্ণব ও শাক্ত ধর্মের
প্রসার একই তালে আদিগঙ্গার
জোয়ারের গতির চেয়ে উচ্চগতিতে
এগিয়ে চললো।
এই কালপর্বেই ১২৫২ বঙ্গাব্দের ২৭
ফাল্গুন ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হলো রাধানাথ জিউ
মন্দিরের। প্যারিমোহন
দাস ও মণিমোহন দাস
যে এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা
তা জানা যায় মন্দিরের
সদর দরজার বাঁদিকের একটি
ফলক থেকে।বাওয়ালির
রাজপরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের কোনা
প্রমাণ আজ মেলেনা বটে,
তবে এটি বেশ প্রচলিত
যে এই মন্দির নির্মাণে
বাওয়ালি রাজবাড়ির ভূমিকা ছিলো অপরিসীম।যাই
হোক।১২৫৩
সালের চৈত্র সংক্রান্তির দিন
মন্দিরের নির্মাণকার্য শেষ হলো।১২৫৪ সালের বৈশাখের
প্রথম দিনে মহা আড়ম্বরে
পূজিত হলেন গোপীনাথ।আজও প্রতি চৈত্রের
পূর্ণিমায় দেবতার বিশেষ পুজোর
আয়োজন হয়ে থাকে।
মন্দির
গাত্রে খদিত সাল-তারিখ
দেখে বোঝা যায়, রাণী
রাসমণি তখনও দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে
ভবতারিণীকে প্রতিষ্ঠা করেননি।ইংরেজ
শাসিত ভারতবর্ষে তখনও সিপাহিরা বিদ্রোহী
হননি।এমনই
সময়কার এক উল্লেখযোগ্য দলিল
এই রাসমন্দির।
মন্দিরের
ভিতরের সাদা ও কালো
মার্বেলপাথর দিয়ে দাবার ছকের
আদলে নির্মিত সুবৃহৎ অঙ্গনটি দেখলে
দুচোখে নেমে আসে এক
অপার্থিব ঐশ্বরিক চেতনা। মন্দিরে
ঢুকেই প্রথম চোখে পড়ে
উত্তর দিকের একটি নবরত্ন
মন্দির, আর তার পাশের
দুই দিকের দুটো পঞ্চরত্ন
মন্দির। নবরত্ন
মন্দিরটি উৎসর্গ করা হয়েছে
শ্রী শ্রী গোপাল জীউ
এর নামে। আর
পঞ্চরত্ন মন্দির দুটি কাশীপতি
শিবকে উৎসর্গ করা হয়েছে। গোপালের
মূর্তিটিও অনন্যসুন্দর।পুরো
মন্দির চত্বরের ভিতরের দেয়াল ঘেঁষে
আছে ১২ টি শিবমন্দির,
যাতে আছে কষ্টিপাথরের শিবলিঙ্গ। তবে
সংস্কারের অভাবে, আজ সবই
ভগ্নপ্রায়।
একসময়
রাস উপলক্ষে বিরাট মেলা, কথকতা,
যাত্রাপালার দিনগুলো আজ কেবলই ইতিহাস। আর
একটি ইতিহাস রয়েছে যার
সংরক্ষণটা বোধ হয় সবার
আগে প্রয়োজন। তা
হলো ভাষার ইতিহাস।
মন্দিরের
গায়ে মোট তিনটে ফলক
আছে।তিনটে
ফলকের বৈশিষ্ট্য তিন রকম।মন্দিরে ঢুকতে বাঁদিকের স্তম্ভে
লেখা,-
"সকলের
চরণে আমার এই নিবেদন।
দেবালয়ে
যাইবে না করিয়া আরোহণ।।
নিষেধ
বিধি কহি কিছু সভার
অগ্রভাগে।
গাড়ি পালকি ঘোড়া গজাদি
নিষেধ আগে।।
পাদুকা
পদেতে আর শিরে ছত্র
ধরে।
না যাইবে গঙ্গাস্নানে দেবের
মন্দিরে।।
মুনিবাক্য
হেলন করে জাইতে জাহার
মন।
শপথ আছয়ে প্রবেশ করিতে
অঙ্গন।।
আরব্ধ
সন ১২৫২ সাল তারিখ
২৭ ফাল্গুন
পিতিষ্ঠা
সন ১২৫৩ সাল, তারিখ
৩১ চৈত্র।।"
শ্রীপ্যারিলাল
দাস। শ্রীমণিমোহন
দাস।
সে যুগে বাংলা গদ্যের
চলাচল শুরু হয়নি।
অতএব এই পয়ার ছন্দেই
বিজ্ঞপ্তি জারি করতে হয়েছে।
আবার মন্দিরের ডানদিকে একলাইনে লেখা,-
এই শ্রীশ্রীবাঁটীতে কেহ পাদুকা পায়ে
দিয়া জাইবেন নাই, যে
জাইবেন তাহাকে তাল্লাক
সন ১২৫২ সাল
তাল্লাক,
মানে তালাক, খাঁটি আরবি
শব্দ।পোপীনাথের
মন্দিরের গায়ে আরবি শব্দ
প্রমাণ করে যে নজরুল
পূর্ববর্তী যুগেও আরবি ভাষার
প্রচলন ছিলো।তবে
জ্ঞানেন্দ্রমোহনের বাংলা অভিধান বলছে
তল্লাক শব্দের অর্থ দিব্যি
বা শপথ।আবার
অন্য অর্থে সম্পর্কে বিচ্ছেদ।অতএব
এক্ষেত্রে ঈশ্বরের নামে শপথ করার
কথাই নিশ্চই বলা হয়েছে।ঘনরাম
চক্রবর্তীর ধর্মমঙ্গল বা চৈতন্য চরিতামৃততেও
তালাক শব্দটি এই অর্থে
ব্যবহৃত হয়েছে। "বীর
বলে তোকে তালাক ভেড়ের
ভেড়ে"(ধর্মমঙ্গল)। ‘তাহারে
তালাক দিব কীর্ত্তন না
বাধিবে’ (শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত)। তবে
আশ্চর্যের বিষয় শুধু সাহিত্যের
পাতাতেই নয়, মন্দির গাত্রেও
অনাবিল আরবি ভাষার প্রয়োগ।
আর একটি ফলক রয়েছে
মূল ফটকটি পেরিয়ে ডান
হাতে।সংস্কৃত
ও বাংলার মাঝামাঝি কোনো
এক ভাষায় লেখা গোপালের
বন্দনা।হরফটা
বাংলা, ভাষাটা ঠিক আজকের
বাংলা নয়।
পুঁথির
পাতাগুলো জাদুঘরের গুদামঘরে হলেও কিছুটা সংরক্ষণের
সুযোগ পায়, কিন্তু এই
প্রস্তরফলকগুলি রোদ-ঝড়-বৃষ্টিতে
মন্দিরটার মতোই ভগ্নপ্রায়।তার অতীতের প্রাচুর্যের
দিন আর নেই।সংলগ্ন আদিগঙ্গার ঘাটটিও
ব্যবহারের অযোগ্য। আজ
থেকে দেড়শো বছরেরো বেশি
আগে প্রিমোহন ও মণিমোহন যে
মৃতপ্রদীপটি জ্বলিয়েছিলেন, তার শিখাই আজ
শুধু নিভন্ত নয়, বন্ধ
হয়ে আসছে বাংলার প্রাচীন
সংস্কৃতির একটা অধ্যায়ের পৃষ্ঠা।
রাসবাড়ির
অদূরেই ছেলেবেলার একটা বিস্তীর্ণ সময়
কাটালেও রাসের দিন ছাড়া
মন্দির প্রবেশের সুযোগ সে অর্থে
হয়নি।আজকে
অস্তগামী সূর্যের শেষ রশ্মিপাতের ছটায়
মুখরিত মন্দির প্রাঙ্গণটি দর্শনের
স্মৃতিটা সহস্র রক্তসন্ধ্যা পেরিয়েও
অমলিন থাকবে স্মৃতির মণিকোঠায়।
তথ্যসূত্র
এবং চিত্রেঃ শ্রীমান্ হৃত্বিক চক্রবর্তী
No comments:
Post a Comment