ঐতিহ্যের
ইতিহাসপর্বঃ
আজ "বনেদীর-বনেদীয়ানা"য়
আবারও এক অনন্য ইতিহাস। আজ
আলোচনায় অম্বিকা কালনার লালজী মন্দির। ইতিহাসের
সন্ধান নিয়ে এলেন পরিবারের
সদস্য শ্রীমান্ সূর্যশেখর এবং তা লিপিবদ্ধ
করলেন শ্রীমান্ শুভদীপ।
অম্বিকা কালনায় কিছু জমিদার
বা ধনী সমাজ বা
ভক্তরা মন্দির তৈরী করেছিলেন
কিসের আকর্ষণে? শুধু কি তাঁদের
প্রতিপত্তি বাড়াবার জন্যে? অবশ্যই এখানে
স্থান মাহাত্মই মুখ্যতম কারণ। এখন
যেমন যত্র-তত্র মন্দির
তৈরী, এমন কি পরের
জায়গা দখল করে, কিম্বা
জনসাধারণের চলার রাস্তা দখল
করে মন্দির তৈরী মনে
হয় এক শ্রেণীর লোকের
সময় কাটাবার বা ব্যবসার উদ্দেশ্যেই
করা হয়। তখন
কিন্তু মানুষ এইসব কল্পনাতেও
আনতে পারতেন না।
তখন দেশের লোকের উন্নতির
জন্য, উত্তর পুরুষের মঙ্গলের
জন্য বা কোন অভিষ্ট
সিদ্ধির জন্য মন্দির নির্মাণ
করা হত। শ্রীচৈতন্যদেবের
অন্যতম উপদেশই ছিল মন্দির
নির্মাণ জীবনের শ্রেষ্ঠ কর্তব্য। তার
চেয়েও শ্রেষ্ঠতম প্রাচীন মন্দির সংস্কার করা। এই
কারণেই তিনি শ্রীধাম বৃন্দাবনে
অনেক লুপ্ত মন্দির উদ্ধার
ও সংস্কার করেছিলেন। এখনও
তাঁর উপদেশ মেনে নিয়ে
বহু ভক্ত প্রাচীন মন্দির
সংস্কারকেই জীবনের কর্তব্য বলে
মনে করেন। এই
মন্দিরময় কালনায় বর্ধমান মহারাজাদের
মন্দির তৈরীর কৃতিত্ব কিন্তু
শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা
উচিত।
বর্ধমান মহারাজারা জাতিতে ছিলেন হিন্দুপাঞ্জাবী। পুর্বপুরুষ
কীর্তিমান আবু রায় ও
বাবু রায়। সুদূর
পাঞ্জাব থেকে বাংলায় আসেন
ভাগ্য অনুসন্ধানে। তখন
বাংলায় সবেমাত্র ঘোড়ার সাহা্য্যে ডাকবিলি
ব্যবস্থা শুরু হয়েছে।
ঠিক সেইসময়ে আবু রায় ও
বাবু রায় বাংলায় এলেন
ঘোড়া ও কম্বলের ব্যবসা
করতে। প্রথম
ব্যবসা করলেন বর্ধমানের কাছে
বৈকুণ্ঠপুর গ্রাম থেকে।
বৃটিশ সরকারকে ঘোড়া ব্রিক্রি আরাম্ভ
করলেন। ব্যবসাও
ক্রমশ বাড়তে লাগল।
এই ঘোড়ার ব্যবসার জন্যই
তখন তাঁদের প্রভাব প্রতিপত্তিও
বাড়তে লাগল এবং অর্থও
আসতে লাগল। পরে
তাঁরা কিছু জমিদারি সরকারের
কাছ থেকে খাজনা দিয়ে
ইজারা নিলেন। জমীদারী
লাভের পর তাঁরা "রাজচিহ্ন"
বা "টোটেম" হিসেবে কেশরযুক্ত ঘোড়ার
মুখ ব্যবহার করেন। আজও
বর্ধমান মহারাজার যে সব সম্পত্তি
ও মন্দির আছে সেখানে
এই কেশরযুক্ত ঘোড়ার মুখের ব্যবহার
দেখা যায়।
একদিন বর্ধমানের বৈকুণ্ঠপুর
গ্রাম থেকে রাজমাতা ব্রজকিশোরী
কালনায় এসেছিলেন গঙ্গাস্নানে। সময়টা
পৌষ মাসের মাঝামাঝি।
তখন পশ্চিম থেকে বহু
ভক্ত ও সাধকরা গঙ্গা
দিয়ে নৌকাযোগে গঙ্গাসাগর যেতেন। নদী
থেকে সাগরের এই জলপথ
তখন খুবই ভয়ের।
একবার এই তীর্থে গেলে
ফিরে আসার নিশ্চয়তা থাকে
না। মাঝে
কালনা একটা কৃষিপ্রধান শহর
এবং তীর্থক্ষেত্রও বটে। অনেকেই
এখানে যাত্রাবিরতি ঘটান। এমনি
এক নাগা সাধুর দল
ছাউনী ফেলেছেন কালনার গঙ্গার ধারে। নাগাবাব
রয়েছেন তাঁবুর ভেতরে, আর
বাইরে তাঁর চেলারা এদিকে
ওদিকে বিশ্রাম করেছেন। রাজমাতা
ব্রজকিশোরীর পালকি চলেছে সেই
তাঁবুর পাশ দিয়েই গঙ্গার
ধারে। হঠাৎ
রাজমাতা শুনতে পেলেন তাঁবুর
ভিতরে সাধু এক ছোট্ট
ছেলের সঙ্গে গল্পে মশগুল। নানা
রকম বায়না সেই ছোট্টো
ছেলের, আর ভেতরে যে
বয়স্ক ব্যক্তি রয়েছেন তাঁর তা
পুরণ না করার ব্যর্থতা। শুনতে
শুনতে রাজমাতার হাঁটা মন্থর হল। মনে
মনে ভাবতে লাগলেন, সাধুরা
চলেছেন দুর্গম তীর্থপথ গঙ্গাসাগরে। সঙ্গে
কোন জেনানাও নেই। তবে
এঁদের সঙ্গে ছোট্ট বালক
কেন? এই চিন্তা নিয়েই
গঙ্গস্নান সারলেন। তারপর
মহারাণি পায়ে পায়ে এসে
তাঁবুর কাছে দাঁড়ালেন।
দেখলেন ভেতরে এক সৌম্য
দর্শন সাধু। রাণীমা
তখন তাঁর দর্শনপ্রার্থী হলেন। সঙ্গে
সঙ্গে অনুমতি পাওয়া গেল। প্রণাম
করার পর সাধুকে জিজ্ঞাসা
করলেন- তিনি গঙ্গাস্নানে যাওয়ার
সময় যে বালকের গলা
শুনেছিলেন, সেই বালকটি কোথায়?
সাধু কোন বালকের কথা
স্বীকার করেন না।
তিনি উত্তর দেন তাঁর
সঙ্গে রয়েছেন শুধু উপাস্য
দেবতা কানাই এর মূর্তি। মহারাণর
সন্দেহ যায় না।
তিনি নিজের কানকে কি
করে অবিশ্বাস করেন? তখনই তিনি
মনে মনে ওই মূর্তিপুজোর
বাসনা করেন।
এ যেমন তেমন মূর্তি
নয়। সাধুর
কাছে জাগ্রত কানাই।
কিন্তু সাধুর কাছ থেকে
মূর্তি চেয়ে নিতেও পারেন
না। অনেক
ভেবে এক বুদ্ধি বার
করলেন। মহারাণি
প্রস্তাব দেন তাঁর কাছে
এক বিবাহযোগ্যা কন্যা আছে।
তার সঙ্গে ঐ কানাই
এর বিবাহ দিতে সাধু
রাজী কি না?? সাধুদের
বলা হয় লালাজী।
অবশ্য বিষ্ণুকেও লালাজী বলা হয়। ঐ
লালাজী এক কথায় রাজী
হলেন। লালাজী
মহারাণির কাছে ঐ কানাই
এর মূর্তি রেখে বিবাহের
ব্যবস্থা করতে বলেন।
এরপর লালাজী গঙ্গাসাগর যাবার
প্রস্তুতি আরম্ভ করেন।
এদিকে মহারাণি ব্রজকিশোরীদেবী মাইজী'র(মাঝির)
বাড়ি থেকে সংগ্রহ করলেন
এক রাধারাণি মূর্তি। পরিবর্তে
দেওয়া হল প্রচুর দেবোত্তর
সম্পত্তি ও রাণিমার সাথে
নতুন সম্বন্ধ পাতানো হল।
মহারাণিমা দুই যুগল মূর্তিকে
প্রতিষ্ঠা করলেন দেবালয়ে।
এই দেবালয়টিও করা
হয় নয়নাভিরাম। রাণিমার
প্রত্যক্ষ ইচ্ছায় তৈরি হল
এই দেবালয়। গঙ্গাসাগরে
তীর্থ ভ্রমণ শেষে লালাজী
ফিরে এলেন কালনায়।
রাণিমার কাছে চাইলেন কন্যা
সহ কানাইকে। মহারাণি
জানালেন যে, তাঁদের বংশের
রীতি অনুযায়ী কন্যাসহ জামাতা শ্বশুরালয়ই থাকেন। লালাজীও
রাজি নয় তাঁর কানাইকে
ছেড়ে থাকতে। লালাজী
অনেক কাতর অনুরোধ জানালেন। যখন
কিছুতেই কিছু হল না
তখন লালাজী তাঁর প্রাণের
দেবতা কানাইকে অভিশাপ দিলেন যে
রাজবাড়িতে এসে ভাল ভাল
খাবার খেয়ে আর যাবার
ইচ্ছে করছে না, তাই
শেষে তাঁর পোড়া রুটি
জুটবে। আগে
লালাজীর কাছে কানাই এই
পোড়া রুটিই সেবা করতেন। রাণিমার
বাহান্ন ভোগ দেওয়ার পর
লালাজীর নিবেদিত পোড়া রুটি কানাইকে
সেবার জন্য দেওয়া হত। লালাজী
কানাইকে ছেড়ে চলে যেতে
পারেন নি। সব
ভোগ দেওয়ার পর নিজের
হাতে তৈরি পোড়া রুটি
দিতেন তাঁর কানাইকে।
এইভাবে ঐতিহ্য ও
আধুনিকতার মেলবন্ধনের সাথে আজও পুজো
পান তিনি কালনায়।
তথ্যসূত্র
এবং চিত্রঃ শ্রীমান্ সূর্যশেখর
রায় চৌধুরী
No comments:
Post a Comment