ঐতিহ্যের ইতিহাসপর্বঃ
আজ বনেদীয়ানা'য়
প্রকাশিত হল রাজপুর অঞ্চলের
প্রাচীন বিপত্তারিণী চণ্ডী বাড়ির ইতিহাস। মায়ের
প্রাচীন ইতিহাসের সন্ধান নিয়ে এলেন
পরিবারের দুই গুরুত্বপূর্ন সদস্য-
শ্রীমান্ শুভদীপ রায় চৌধুরী
এবং শ্রীমান্ সৌমজিৎ মাইতি।
আলোচনায় আজ রাজপুরের মা
বিপত্তারিণী।
"দুর্গান্
শিবান্ শান্তিকরিং ব্রহ্মাণী ব্রহ্মণ্যপ্রিয়াং সর্ব্বলোকঃ প্রণেতিঞ্চ প্রণমামি সদাশিবাম্। মঙ্গলাং
শোভনাং শুদ্ধাং নিষ্কলাং পরমাঙ্কলাং বিশ্বেশ্বরীং বিশ্বমাতাং চণ্ডিকাং প্রণমাম্যহম।।"
বিপত্তারিণী চণ্ডী বাড়ির ইতিহাস
শুরুতেই শ্রী গোকুল ঘোষের
উক্তিই মনে আসে-
"রাজপুর
ধামে বিপত্তারিণী নামে,
স্থাপিলে চণ্ডীরে,
করি কোলাহল বসিয়া
সকল
সেই সুধা-সাগরের
তীরে।
দেহো গো সু-জ্ঞান হে মহারাজন
আমাসম মূঢ় জনে,
তোমারি কথন করিয়া
যতন
জানাব বিশ্বজনে।।"
পশ্চিমবঙ্গের
দক্ষিণে ২৪পরগণা জেলার অন্তর্গত রাজপুর
গ্রাম। কলিকাতা
নগরীর শিয়ালদহ সাউথ স্টেশন থেকে
২৪পরগণার বিভিন্ন গ্রামে বা শহরে
ট্রেনযোগে আসা যায়।
ট্রেন পথে সোনারপুর স্টেশনে
নেমে রাজপুর আসা যায়। রাজপুর
গ্রামে অধিকাংশ বর্দ্ধিষ্ণু ব্রাহ্মণ পরিবারের বসবাস। তারমধ্যেই
কিছু মাহিষ্য পরিবার অতি সজ্জন
ও সাধু। এই
পরিবারের নিতাইচাঁদ দাশ মহাশয় অতি
সাধু ব্যক্তি ছিলেন। দেবদ্বিজে
ছিল তাঁহার অগাধ ভক্তি। নিঁতাইচাঁদ
দাশ ও অঁপর্ণা দাসীর
একমাত্র পুত্র সাঁধন চন্দ্র
দাশ। সাধন
চন্দ্র দাশের স্ত্রী বসন্তকুমারী
দেবী অতীব নিষ্ঠাবতী কন্যা। তাঁদের
মোট সাতটি সন্তানাদি হয়। পুত্রসন্তান
তিনটি এবং কন্যাসন্তান চারটি। জ্যেষ্ঠপুত্র
দুলালকে গর্ভে ধারন করে
তিনি হয়েছিলেন রত্নগর্ভা। বাংলা
১৩২৩ সালের কার্ত্তিক সংক্রান্তি
বুধবার সকাল ৬টায় বসন্তকুমারী
প্রসব করলেন এক উজ্জ্বল
জ্যোতিষ্ক। বৈষ্ণবগণ
পথে মহাপ্রভুর গান গাইতে গাইতে
চলছিলেন। নবজাত
শিশু ভূমিষ্ঠ হলেন এবং বৈষ্ণবগণ
গান গাইতে গাইতে প্রবেশ
করলেন গৃহে-
"নন্দ
দুলাল এলো নন্দ দুলাল।
ব্রজের গোপাল এলো
ব্রজের রাখাল।।"
নবজাতকের
নাম কেউ দিলেন "নন্দদুলাল"
আবার কেউ বললেন "দুলাল"। গঠন
বৈশিষ্ট্যে অতিব সুন্দর তাঁহার
মুখখানি। নবজলধর
শ্যাম করলেন স্পর্শ বাংলার
মাটি। ধন্য
হল এই মাটি।
জগন্মাতা দক্ষিণা কালিকা নতুন রূপে
নতুন ভাবে আবির্ভূতা হলেন
দুলালের সামনে। শিবোপরি
দিগম্বরী করালবদনা মুণ্ডমালিনী আজ হলেন সিংহবাহিনী
মহাশূল ধারিণী। নাম
তাঁর বিপত্তারিণী চণ্ডী। দক্ষিণা
কালিকা আজ আবির্ভূতা হলেন
মা চঁণ্ডী রূপে।
জগতে যখনই অশুভের প্রভাব
বেড়েছে সেই অশুভকে নাশ
করতে মা ধরাধামে অবতীর্ণা
হলেন বিপত্তারিণী চণ্ডী নামে।
দুলালের গৃহে মা বিরাজ
করলেন ভক্তদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করতে।
বহু দূর দূরান্ত থেকে
ভক্ত আসত দুলালের বাড়িতে
মায়ের দর্শণে। খুব
ছোট্টো স্থানেই চণ্ডীমাতাকে রেখেছিলেন তিনি, ভক্তরা অপেক্ষা
করতেন কখন মায়ের দর্শণ
তারা পাবেন।
আষাঢ় মাস।
বাংলা ১৩৩৪ সাল।
জগন্নাথদেবের রথযাত্রার আর বিশেষ দেরীও
নেই। রথযাত্রা
উৎসবের মধ্যে পঞ্জিকায় শ্রীশ্রী
বিঁপত্তারিনী দুর্গামাতার ব্রতের কথাও উল্লেখ
আছে। কিন্তু
ভক্তরা একটা সংকটে পরলেন
যে পঞ্জিকায় শ্রীশ্রী বিঁপত্তারিনী চণ্ডীমাতার উল্লেখ নেই।
আগ্রহী ভক্তরা তখন বসন্তকুমারী
দেবীকে অনুরোধ করলেন তিনি
যেন এই বিষয়ে সাহায্য
করেন। তখন
বসন্তকুমারী দেবী তাঁর পুত্রকে
নির্দেশ দিলেন চণ্ডীমাতার থেকে
ব্রতের সমস্ত বিধি ব্যবস্থা
ও রীতিনীতি জানার জন্য।
দুলাল বাবা বারবার মায়ের
কাছে বলেন-"দেখ্ মা, পাড়ার
দিদিমা, ঠাকুমা, জেঠিমারা বলছেন যে তোর
নাকি বিপত্তারিণী ব্রত আছে।
ঐ ব্রত পূজার রীতিনীতি
তারা জানতে চায়।"
এইভাবে দশ দিন
কেটে গেল। তারপর
একদিন বালক দুলাল বসে
আছেন নিজের ঘরে চৌকিতে
তখন মা আলোকিত করে
এলেন তাঁর কাছে।
তিনি আনন্দিত হয়ে প্রণাম করলেন
দেবীকে আর তখন বালিকারূপিণী
চণ্ডীমাতা তাঁকে বিপত্তারিণীর ব্রতের
কথা বলতে লাগলেন-
"আষাঢ়স্য
শুক্লপক্ষে দ্বিতীয়ার পর
এই ব্রত আচরিবে
দশমী ভিতর।
পূর্বদিনে
নিরামিশ্য খাবে একবার
এই ব্রত করিবে শুধু
মঙ্গলবার।।
ত্রয়োদশ
গ্রন্থিযুক্ত রক্তবর্ণ ডোরে-
নরনারী
সবে ধর দক্ষিণ করে।।"
এছাড়াও
তিনি আরও বললেন- তের
রকমের ফল আমার ষোড়শোপচারে
দেবে। ষোলো
আনার পরিবর্তে ষোল পয়সা নেবে। ডোরের
নিমিত্ত চার পয়সা আর
দক্ষিণা বাবদ চার পয়সা। দক্ষিণা
ছাড়া ব্রতীর ব্রত পূর্ণ
হয় না, তাই দক্ষিণা
গ্রহন করো। গরীবের
জন্যই আমি এসেছি, তারা
সহজ সাধ্য মতন তাহাদের
মনোস্কামনা পূরণের জন্যই আমার
এই আদেশ।
এইভাবে
চণ্ডীমাতা জানিয়ে গেলেন বিপত্তারিণী
ব্রতের রীতিনীতি। বালক
দুলাল সমস্ত কথা ভক্তদের
বলে দিলেন যা তাঁকে
স্বয়ং মা বলেছেন।
বাংলার ১৩৩৪ সালে বিপত্তারিণী
চণ্ডীব্রত আরাম্ভ হয় এবং
তা আজও প্রচলিত এই
চণ্ডী বাড়িতে। বর্তমানে
মাত্র ৩৫পয়সায় ব্রতাদি সম্পন্ন হয়। প্রচলিত
বিধিমতে শ্রীশ্রী বিঁপত্তারিনী দুর্গাব্রতের কথা উল্লেখ পাওয়া
যায় কিন্তু শ্রীশ্রী বিঁপত্তারিনী
চণ্ডীব্রতের উল্লেখ নেই।
এইরূপে অপ্রচলিত বিপত্তারিণী চণ্ডীব্রত পণ্ডিতমহলকে বিচলিত করে কিন্তু
বালক দুলাল তাতে বিন্দুমাত্র
বিচলত ছিলেন না, কারণ
দেবী তাঁকে স্বয়ং নিজে
বলেছেন ব্রতের সমস্ত নিয়ম। কড়াপাক
সন্দেশ বালক দুলালের প্রিয়
আর চণ্ডীমাতার প্রিয় কাঁচাগোল্লা।
আজ রাজপুরের চণ্ডী
বাড়ি বঙ্গের প্রাচীন মন্দিরের
এক অন্যতম মন্দির।
বহু ভক্তের কাছে আজ
এক তীর্থস্থান এই বিপত্তারিণী বাড়ি। মায়ের
বিগ্রহ ছাড়াও রয়েছে দেবী
দুর্গার বিগ্রহ, রয়েছে বিভিন্ন দেবদেবীর
বিগ্রহ, রয়েছে সাধক দুলাল
বাবার মূর্তি, এবং তাঁর ব্যবহৃত
জিনিসের সংগ্রহশালা।
রয়েছে
রত্নবেদী এবং ভক্তদের পূজা
দেবার জন্য সমস্ত ধরনের
উপকরণের দোকান। বিপত্তারিণী
ব্রতের দিন বহু ভক্তের
সমাগম ঘটে এই চণ্ডীবাড়িতে। মায়ের
কাছে সবার একটাই প্রার্থনা
সবাইকে ভালো রেখো মা।
রত্নবেদীঃ- এটি
বাবা দুলালের সাধন পীঠ, স্থাপিত
বাংলার ১৩৪০ সাল।
সিদ্ধ মহাপুরুষগণ যাঁরা শক্তি সাধনার
দ্বারা ঈশ্বরের স্বরূপ দর্শণে ব্রতী
হন তাঁরা তন্ত্রমতে পঞ্চমূণ্ডের
আসন স্থাপন করেন এবং
তাতে সাধনা করে সিদ্ধিলাভ
করেন। কিশোর
দুলাল জগন্মাতার স্বরূপ দর্শণে ব্রতী
হয়ে পঞ্চমূণ্ডের আসনের জন্য নরমুণ্ড
সংগ্রহ করতে থাকেন।
তাঁর গর্ভধারিণী মা এই সংবাদ
পেয়ে তাকে বিরত করেন
এবং বলেন এমন আসন
তৈরি করো যাতে সকলের
বসার অধিকার থাকে।
তারপর দুলাল বাবা শ্রী
শ্রী চঁণ্ডীমাতার নির্দেশে বিভিন্ন রত্নদ্বারা বিল্ব বৃক্ষ মূলে
যে আসন তৈরি করেন
তাহাই এই রত্নবেদী।
এই রত্নবেদী বাবা দুলালের সিদ্ধাসন। এখানেই
তিনদিন তিনরাত্রি সাধনা করে তিনি
মায়ের দর্শণ পান ও
সিদ্ধিলাভ করেন।
বাবা দুলালের সংগ্রহশালাঃ- এই
সংগ্রহশালায় রয়েছে চাকীবেলুন, রয়েছে
কাঁসার বাটি, রয়েছে খড়ম,
নাড়িকেল মালার কমণ্ডলু যা
বাবাকে ১৩বছর রয়েসে শ্মশানে
জনৈক এক সাধু উপহার
দিয়েছেন, রয়েছে পিতলের ঘটি
ইত্যাদি নানান রকমের জিনিস। এছাড়া
১৯৭০ সালের চণ্ডীমাতা ও
বাবা দুলালের চিত্র, পুরোনো নাটমন্দিরের
চিত্র, ১৯৭৫ সালে নতুন
নাটমন্দিরে মায়ের বিগ্রহ প্রতিষ্ঠার
চিত্র, পুরোনো নাটমন্দিরে বিপত্তারিণী
ব্রতের দিন তোলা ছবি
ইত্যাদি।
আজ তাই বনেদীয়ানা
পরিবারও এই প্রার্থনা জানিয়ে
এলেন মায়ের কাছে।
"জয়
জয় দেবী চণ্ডীর জয়
জয় বিপদতারিণী চণ্ডীর জয়।।
তোমার
শরণাগত আমি মাগো হই।
তোমার
প্রসাদে মাগো রক্ষা যেন
পাই।।
বার বার তাই মাগো
প্রণাম জানাই।
রক্ষা
কর রক্ষা কর আর
কেহ নাই।।"
তথ্যঋণঃ
"বাবা দুলাল"(প্রথম খণ্ড)- শ্রী
পুলিনবিহারী আঢ্য
তথ্যসূত্র
সংগ্রহেঃ শ্রীমান্ শুভদীপ রায় চৌধুরী
এবং শ্রীমান্ সৌমজিৎ মাইতি
চিত্রঋণঃ
শ্রীমান্ শুভদীপ
No comments:
Post a Comment