Thursday, April 25, 2019

নাড়াজোল রাজবাড়ী-প্রথম_পর্ব


ঐতিহ্যের ইতিহাসপর্বঃ 

 আজ প্রকাশিত হল নাড়াজোল রাজবাড়ির ইতিহাস নিয়ে প্রথম পর্ব ইতিহাসের অমূল্য সম্পদ সংগ্রহ করে নিয়ে এলেন সদস্য শ্রীমান্ শঙ্খ প্রথম পর্বের কিছুদিন পর আবার দ্বিতীয় পর্ব প্রকাশিত হবে
নাড়াজোল রাজবাড়ী পশ্চিম মেদিনীপুর


#প্রথম_পর্ব

"শঙ্কর ভোরবেলা চুঁচড়োয়,
হাউ হাউ শব্দে গা মুচড়োয়
নাড়াজোলে বড়বাবু তখুনি,
শুরু করে বংশুকে বকুনি
বংশুর যত হোক খাটো আয়,
তবু তার বিয়ে হবে কাটোয়ায়"
(ভবঘুরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচনাকালঃ ১৯৪০)

আমাদের রবিকবি, নাড়াজলোলের কোন বড়বাবু' মাধ্যমে জনৈক 'বংশু'-কে বকুনি খাইয়েছিলেন সেটা তিনিই জানতেন তো, এই সেদিন কবিতাটা পড়ার সময়ে 'নাড়াজোল' কথাটা হঠাৎ করে মনে ঘা দেয় কি এমন ব্যাপার আছে নাড়াজোলে, যার জন্য তৎকালীন বঙ্গদেশের এতজন রাজন্যকে ছেড়ে কবিগুরু নাড়াজোলের বড়াবাবু'কে নিয়ে টানাটানি করেছেন! খবরটাতো নিতে হচ্ছে! তখনও বুঝিনি যে, কোন "হীরক রাজ্য"-এর খবর নিতে চলেছি! একটু নাড়াঘাঁটা করতেই যা বেড়িয়ে এলো....... রীতিমতো 'চক্ষু চড়কগাছ!' রাজ পরিবারের ইতিহাস খুঁজতে গিয়ে যা যা মূল্যবাণ তথ্য হাতে এলো, এককথায় মাথা ঘুরিয়ে দেবার মতো! কী নেই সেই ইতিহাসে.... ধর্ম, সংস্কৃতি, বিদ্যানুরাগ, স্থাপত্য, রাজনৈতিক(পারিবারিক) অন্তর্দ্বন্দ্ব, সর্বোপরি স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রসঙ্গ, সব লুকিয়ে আছে আজকের ভগ্নপ্রায় নাড়াজোল রাজবাড়ীর ৩৬০বিঘা বস্তুতে! তাই বহু চেষ্টায় সবকিছু ক্রমানুসারে সাজিয়ে পরিবেশন করতে একটু দেরী হয়ে গেলো এরজন্য সদস্যদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী তবে বেশী না গেঁজিয়ে আসল প্রসঙ্গেই আসা যাক
শুরুর থেকে শুরু করলে জানা যায়, দিল্লীর মসনদে যখন সৈয়দ বংশীয় দ্বিতীয় শাসক সিকন্দর শাহ্(১৪২১-১৪৩৪) রাজত্ব করছেন, সেইসময়ে(আনুমানিক ১৪২৫ খ্রীস্টাব্দ) নাড়াজোল রাজপরিবারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয় স্থাপকের নামঃ স্বর্গীয় উদয়নারায়ণ ঘোষ

'নাড়াজোল' শব্দের উৎপত্তি 'নাড়াজোট' কথা থেকে বঙ্গীয় অভিধানের সহায়তায় জানা যায়, 'নাড়া' শব্দের অর্থ 'খড়'(ধান ঝেড়ে নেবার পরে, ধানগাছের অবশিষ্ট অংশ) এবং 'জোট' শব্দের অর্থ ক্ষুদ্র নদী নাড়াজোটের ভৌগোলিক অবস্থান লক্ষ্য করলেই স্পষ্ট দেখা যায় যে, এই ভূখণ্ড উত্তরে শীলাবতী, দক্ষিণে কংসাবতী, পূর্বে কাঁকি এবং পশ্চিমে পারাং নামক চারটি বৃষ্টজলপুষ্ট ছোটো নদী দ্বারা পরিবেষ্টিত এককালের নদীবেষ্টিত আংশিক বন তথা আংশিক কৃষিভূমি 'নাড়াজোট'- আজকে অপভ্রংশে 'নাড়াজোল' হয়েছে

জনশ্রুতি, অবিভক্ত বর্ধমান জেলা নিবাসী বর্ধিষ্ণু ব্যবসায়ী উদয়নারায়ণ ঘোষ মাঝেমধ্যেই নাকি শিকারের নেশায় এদিকওদিক বেড়িয়ে পড়তেন এইরকমভাবে একবার ঘুরতে ঘুরতে একবার তিনি এসে হাজির ' নদীবেষ্টিত বনভূমি নাড়াজোলে শিকারের সন্ধানে জলাভূমি পেড়িয়ে বনভূমিতে প্রবেশ করে, বেশ কিছুটা অগ্রসর হবার পরে দৈবাৎ নিজেরই অন্যমনস্কতায় দিগ্ভ্রান্ত ' ক্রমে পথের রেখা ধরে ইতস্তত এদিকওদিক করতে করতেই রাত্রি নামে নিরুপায় উদয়নারায়ণ রাত্রে জঙ্গলেই কাটানোর পরিকল্পনায় একটি গাছের ডালে আশ্রয় নে' মধ্যরাত্রে ঘুমের মধ্যেই দেবী দশভূজা, ঘোষ মশাইয়ের স্বপ্নে প্রকট ' নির্দিষ্ট জায়গায় পোঁতা ধনসম্পদ দেবীর অষ্টধাতু নির্মিত বিগ্রহের খোঁজ দিয়ে উদয়নারায়ণ'কে সেই অঞ্চলেই বসতি স্থাপনের আদেশ দে'
উদয়নারায়ণ সেই নদীনালা কেন্দ্রিক অঞ্চলেই স্বজাতীয় কয়েকটি পরিবার আসেপাশের কয়েকঘর প্রজাকুল'কে নিয়ে সর্বমোট ৫৫ঘর বসতি স্থাপন করেন এইভাবেই প্রায় পরিত্যক্ত জলাকীর্ণ বনভূমি জনবসতিতে রূপান্তরিত হয় এবং উদয়নারায়ণ ঘোষ সেই অঞ্চলের অধিপতি হয়ে বসেন

পরবর্তীকালে বংশানুক্রমে প্রতাপনারায়ণ, যোগেন্দ্রনারায়ণ, ভরতনারায়ণ, কার্ত্তিকরাম প্রমুখেরা নাড়াজোলের অধিপতি ' প্রসঙ্গত, কার্ত্তিকরাম ঘোষ তৎকালীন বাংলার অধীশ্বর সোলেমান করবানির কাছ থেকে নাড়াজোল এবং তৎসংলগ্ন ঘাটাল, ডেবরা, দাসপুর, কেশপুর সমেত নাড়াজোলের জমিদারীসত্ত্ব 'রায়' উপাধিতে ভূষিত ' সেই থেকেই নাড়াজোলের 'ঘোষবংশ', 'রায়বংশ'-এর পরিচিতি পায় কার্ত্তিকরামের বংশধর জয়মণি রায়ের পুত্র শ্যামসিংহ রায় নাড়াজোলা জনপদকে একটি বর্ধিষ্ণু অঞ্চলে পরিণত করেন এবং জমিদারীর সীমানায় 'ফতেঃগড়' নামক একটি 'গড়বাড়ী' নির্মাণ করান
তৎকালীন মুঘলসম্রাট মহামতি আকবর অখণ্ড ভারতবর্ষের শাসনকার্য্য পরিচালনার সুবিধার্থে সমগ্র ভারতবর্ষকে অসংখ্য 'সুবা' এবং 'প্রদেশ'- বিভক্ত করেন বাংলাদেশের 'সুবাদার' ' সম্রাট আকবরের এক বিশ্বস্ত রাজকর্মচারী 'সুলতান নাজিম' ১৫৯৬ খ্রীস্টাব্দে সুলতান নাজিমের থেকেই নাড়াজোলের জমিদার শ্যামসিংহ রায় 'খান' উপাধি লাভ করেন সেই থেকে 'রায়' উপাধি ত্যাগ করে জমিদারবংশ 'খান' উপাধিই গ্রহণ করেন জমিদার শ্যামসিংহ খানের উত্তরাধিকার হিসাবে বংশানুক্রমে বলবন্ত, গুণবন্ত, মহেশ, অভিরাম, যদুরাম, মতিরাম, সীতারাম আনন্দলাল প্রমুখেরা খান বংশীয় জমিদার হিসাবে নাড়াজোল জমিদারীর আসন অলঙ্কৃত করেন

এরপরেই সিংহাসনে বসেন জমিদার মোহনলাল খান বলা হয়, মোহনলালের জমিদারী আমলই নাড়াজোলের স্বর্ণযুগ তাঁর সর্বপ্রথম কীর্তি 'গড় নাড়াজোল'- ৩৬০বিঘা জায়গা জুড়ে 'বহির্গড়' 'অন্তর্গড়' বিভাগে বিরাট বসতবাড়ী স্থাপন করা সর্বমোট ত্রিস্তরীয় ধাঁচে নির্মিত রাজবাড়ীর নহবতখানা, খাজাঞ্চিখানা, মুহুরিখানা, অতিথিশালা, বহির্মহল অন্দরমহল মিলিয়ে ৩৫০টির' বেশী কক্ষসমন্বিত 'কমপ্লেক্স' নির্মাণ করিয়েছিলেন নাড়াজোলের স্থাপত্যশিল্পের ইতিহাসে ইন্দো-ইয়োরোপীয় শিল্পরীতির অপূর্ব সমন্বয় লক্ষ্যনীয় ১৮১৮ খ্রীস্টাব্দে নাড়াজোলের খুব কাছেই লঙ্কাগড়ে প্রায় ৬০বিঘা জমি খনন করিয়ে পরিখা বেষ্টিত ইটালিয়ান স্থাপত্যশৈলীর অনুকরণে একটি বসতবাড়ী বা বলা ভালো গ্রীষ্মকালীন বাসভবন নির্মাণ করান এটি 'জলহরি' নামে পরিচিত সেই সময়ে বাসভবনটি তৈরী করাতে আনুমানিক ৮০হাজার টাকা ব্যয় করেছিলেন মোহনলাল এছাড়াও রাজবাড়ীর অন্তর্গড়ে রাজবংশের কুলদেবী শ্রী শ্রী জয়দুর্গার দালানকোঠা, কুলদেবতা শ্রী শ্রী সীতারাম সপ্তদশী রত্নমন্দির, ছয়টি শিবদেউল সহ "বেলজিয়াম গ্লাস"-এর অলঙ্করণ সমৃদ্ধ দোলমঞ্চ, রাসমঞ্চ, শ্রী জয়দুর্গার নাটমন্দির রঙমহল নির্মাণ করান এইসকল দেবালয় নির্মাণের জন্য মোহনলাল খান প্রায় তিনলক্ষ টাকা ব্যয় করেন বিভিন্ন মন্দিরের অলঙ্করণ শিবলিঙ্গ নির্মাণের উদ্দেশ্যে রাজস্থান থেকে মার্বেল পাথর অযোধ্যা থেকে কোষ্টিপাথর আনানো হয়েছিলো প্রসঙ্গত, কোনো একসময়ে এই রাজবাড়ী পরিদর্শনে আসনে সপুত্র(কনিষ্ঠ) মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর দেবী জয়দুর্গার নাটমন্দিরের অলঙ্করণ তাঁর এতটাই মনে ধরে যে, পরবর্তীকালে শান্তিনিকেতন আশ্রমের উপাসনা কক্ষটি নির্মাণের সময়ে কারিগরদের শিল্পরীতিই অনুসরণ করিয়েছিলেন

১৮২৮ খ্রীস্টাব্দে মোহনলাল, বর্তমান রাজনগর অঞ্চলে একটি মঠ তথা দীনদরিদ্রদের উদ্দেশ্যে লক্ষাধিক টাকা ব্যয় করে একটি সদাবর্ত নির্মাণ করান এর ঠিক দু'বছর পরেই পুণ্যাত্মা মোহনলাল দেহরক্ষা করেন............ ক্রমশঃ
তথ্যসূত্র এবং চিত্রঃ শ্রীমান্ শঙ্খ



No comments:

Post a Comment