Sunday, April 21, 2019

ত্রিপুরার মাণিক্য রাজবংশের কুলদেবতা


ঐতিহ্যের ইতিহাসপর্বঃ 
আজ আলোচনায় ত্রিপুরার মাণিক্য রাজবংশের কুলদেবতার মন্দিরের ইতিহাস বনেদীয়ানা সবসময় প্রাচীন সত্য ইতিহাস রচনার এক অন্যতম সংগঠন হিসাবে কাজ করছে আজ তাই ত্রিপুরার প্রাচীন ইতিহাস লিপিবদ্ধ করলেন সদস্য শ্রীমান্ সাবর্ণ গোত্রীয় জয়দীপ ভট্টাচার্য্য

ত্রিপুরার প্রাচীন ইতিহাসের একমাত্র প্রামাণ্য দলিল হলো রাজমালাত্রিপুরার মাণিক্য রাজবংশের উৎপত্তি,ত্রিপুরার উত্থান, রাজত্ব,যুদ্ধ,বিজয়,পরাজয়,স্থাপত্য সবই লিপিবদ্ধ আছে রাজমালায়যদিও রাজমালার কিছুকিছু ব্যাখ্যা ইতিহাসসম্মত নয়, তবু ত্রিপুরার আদি ইতিহাস সম্বন্ধে রাজমালা ছাড়া অন্য কোন লিখিত পাণ্ডুলিপি না থাকায় রাজমালাই একমাত্র ভরসা
রাজমালার মতানুসারে চন্দ্রবংশীয় রাজপুত্র দ্রুহ্য নিজ পিতা কর্ত্তৃক ত্যাজ্য হয়ে কপিলমুনির শরণাপন্ন হলেনকপিলমুনি দ্রুহ্যকে নতুন রাজ্য প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দিলে,উনি ত্রিবেগ নামক নতুন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন যা বর্তমান আসামের কাছাড় বাংলাদেশের শ্রীহট্টের কিছু অঞ্চল নিয়ে অবস্থিত ছিলোকপিলমুনিই ত্রিপুরার প্রথম রাজগুরুসময়ের সাথে সাথে রাজ্য ক্রমশ দক্ষিণে সরে আসে,সাথে রাজধানীও চলে আসে তৎকালীন রাঙ্গামাটি তথা বর্তমান উদয়পুরে
মহারাজ দ্রুহ্যকেই ত্রিপুরার রাজবংশের আদিপুরুষ হিসাবে ধরা হয়মহারাজ দ্রুহ্যের বংশধর মহারাজ ত্রিপুর ছিলেন প্রচণ্ড নৃশংস এবং অত্যাচারীরাজার অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে স্বয়ং মহারাণী হীরাবতী প্রজাদের সাথে নিয়ে দেবাধিদেব মহাদেবের শরণাপন্ন হলে মহাদেব স্বয়ং প্রকট হয়ে নিজ ত্রিশূল দ্বারা রাজা ত্রিপুরের বধ করলেনরাজমালা অনুসারে মহাদেব কর্তৃক ত্রিপুর বধের পরই ত্রিবেগ রাজ্যের নাম হয় ত্রিপুরাত্রিপুর বধ তো হলো, কিন্তু রাণীমা তখনো নিঃসন্তান,বংশরক্ষার জন্য বিধবা রাণী হীরাবতী মহাদেবের তপস্যা করলে,মহাদেব তুষ্ট হয়ে শিবঅংশ রাণীমার গর্ভে স্থাপন করেননয়মাস পর রাণীমা শিবতুল্য পুত্র ত্রিলোচনের জন্ম দেন,শিবঅংশে জন্ম বলে ভূমিষ্ট হবার পর ত্রিলোচনের ললাটেও নাকি একটি তৃতীয়নয়ন দেখা গিয়েছিলোরাজপুত্র ত্রিলোচন বড় হতে লাগলোএকদিন রাণীমা গোমতী নদীতে স্নান করতে যাচ্ছিলেন,পথে কারো আর্তনাদ শুনে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে চারিপাশে তাকিয়ে দেখলেন কাছেই একটা বড় গাছের উপর চৌদ্দজন ভয়ে কাঁপছে,আর নীচে একটা বিশালাকার ষাঁড় রাগে ফুঁসছে আর বারবার গাছে ধাক্কা দিচ্ছেরাণীমা তৎক্ষণাৎ নিজের পড়নের পাছড়া (ত্রিপুরী সম্প্রদায়ের মহিলাদের পারম্পরিক পোশাক,অনেকটা শাড়ির মতই)খুলে ষাঁড়ের মুখ পেছন থেকে বেঁধে দিলেনষাঁড় দিকবিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটে পালিয়ে গেলে গাছের উপর থেকে চৌদ্দজন একে একে নেমে এলেনরাণীমা তাদের পরিচয় জিজ্ঞেস করলে,উনারা নিজের আসল স্বরূপ ধরে বললেন যে উনারা চৌদ্দ জন দেবদেবী রাণীর প্রজাবৎসলতার পরীক্ষা নেওয়ার জন্য মায়ার জাল পেতেছিলেনরাণীমা সাষ্টাঙ্গ প্রণাম জানিয়ে তাঁদের সাদরে রাজপ্রাসাদে নিয়ে আসেন কুলদেবতা রূপে প্রতিষ্ঠা করে সাড়ম্বরে নিত্যপুজো শুরু করেন
কিছুদিন পর ত্রিলোচন মহারাজ হলে চৌদ্দ দেবতার জন্য আলাদা মন্দির নির্মাণ করে দেনকথিত আছে যে মহারাজ ত্রিলোচন ছিলেন মহাভারতের যুদ্ধের সমসাময়িকযুদ্ধে তিনি যুধিষ্ঠিরের পক্ষ অবলম্বন করেন এবং বিজয়ের পর যুধিষ্ঠির একটি রূপার সিংহাসন ত্রিলোচনকে দান করেন যা অদ্যাবধি ত্রিপুরার রাজসিংহাসন রূপে উজ্জ্বয়ন্ত প্রাসাদে রক্ষিত আছে

মহারাজ ত্রিলোচনই প্রথম কুলদেবতা চৌদ্দদেবতার পূজাপদ্ধতি প্রবর্তন করেন,যা অদ্যাবধি বর্তমান
এই চৌদ্দজন দেবতা হলেন হর,হরি,উমা,লক্ষ্মী,বাণী,কুমার,গণপতি,বিধি,হিমালয়,গঙ্গা,ধরিত্রী,অগ্নি,কাম,সমুদ্র
ত্রিলোচন সম্ভবত উদয়পুরেই চৌদ্দ দেবতার মন্দির প্রতিষ্ঠা করেনপরে রাজারা যতবার রাজধানী পরিবর্তন করেছেন ততবার সাথে করে কুলদেবতাকে নিতে গেছেনঅষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে রাজধানী উদয়পুরে শমসের গাজী দ্বারা মুসলিম আক্রমন সংঘটিত হলে রাজারা উদয়পুর ত্যাগ করেনশমসের গাজীর মৃত্যুর পর ১৭৬০ সালে মহারাজ কৃষ্ণমাণিক্য রাজা হয়ে উদয়পুর পুনরায় দখল করলেও রাজধানী সরিয়ে নিয়ে আসেন প্রায় ৬০ কিমিঃ উত্তরে হাওড়া নদীর তীরবর্ত্তী পুরাতন আগরতলায়সাথে করে নিয়ে আসেন কুলদেবতাকে এবং প্রাসাদ প্রাঙ্গণেই মন্দির নির্মাণ করে তাঁদের প্রতিষ্ঠা করেনঅদ্যাবধি চৌদ্দ দেবতা এই মন্দিরেই রয়েছেনতবে পূজার রীতিনীতি চলে আসছে মহারাজ ত্রিলোচনের প্রবর্তিত নিয়মানুসারে১৯০১ সালে মহারাজা রাধাকিশোর মাণিক্য পুরাতন আগরতলার প্রায় ১০কিমিঃ পূর্বে নতুন আগরতলায় উজ্জ্বয়ন্ত প্রাসাদ নির্মাণ করে সেখানে রাজধানী নিয়ে আসেন,কিন্তু  মাত্র ১০কিমিঃর ব্যবধান বলে এবার কুলদেবতাদের আর আনলেন না নতুন আগরতলায়,দেবতারা পুরাতন আগরতলার মন্দিরেই রয়ে গেলেন যেখানে অদ্যাবধি উনারা রয়েছেনমন্দির প্রাঙ্গণে মহারাজ কৃষ্ণমাণিক্যের আমলের একটি দীঘি রয়েছে যা চৌদ্দ দেবতার দীঘি নামে পরিচিত,এই দীঘির জল খুব পবিত্র বলে রাজ্যবাসীর বিশ্বাস,মন্দির প্রাঙ্গণে রয়েছে মহারাণী হীরাবতীর একটি মন্দির যেখানে ভক্তরা রাণীমার প্রতিকৃতিতে সিঁদুর ঢেলে রাণীমার পুজো করেন এবার আসি পূজার নিয়মনীতিতে-
সারাবছর কেবল হর,হরি,উমা এই তিনজনেরই নিত্যসেবা হয় মূলমন্দিরে,বাকিরা থাকেন বাক্সবন্দী
আষাঢ়ের শুক্লাষ্টমীতে চৌদ্দজন চন্তাই'এর কোলে করে চৌদ্দজন দেবতা পুণ্যস্নান করতে যান পার্শ্ববর্তী হাওড়া নদীতে(ত্রিপুরী সম্প্রদায়ের পুরোহিতকে চন্তাই বলে)স্নান শেষে এসে মন্দির প্রাঙ্গনেই অবস্থিত আরেকটা মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত হন আগামী দিনের জন্য
এই দিন সম্পূর্ণ ত্রিপুরী নিয়মে মহারাজ ত্রিলোচনের প্রবর্তিত  পদ্ধতি মেনে পুজো হয় চৌদ্দ দেবতারচৌদ্দ দেবতার বাৎসরিক এই পূজা ক্ষ্মার্চী পূজা নামেই পরিচিতক্ষ্মার্চী পূজার মন্ত্র অত্যন্ত গোপন,কেবল রাজচন্তাই (প্রধান চন্তাই) আর মহারাজাই এই মন্ত্র জানেনক্ষ্মার্চীর সময় রাজচন্তাই রাজবেশে সাজেন,পূজার এই দিন রাজচন্তাই' রাজ্যের রাজা,মহারাজ তখন সাধারণ প্রজামাত্রচৌদ্দ দেবতার উদ্দেশ্যে বলিও হয় তার নিজস্ব নিয়মানুসারে,বলির সময় সামনে একটা বেদীতে নিয়ে আসা হয় দেবতাদেরএই ৭দিন ত্রিপুরী নিয়মানুসারে মদ,হাঁসের ডিম,কবুতর,পাঁঠা বলি দেওয়া হয়

বলির পর আবার পেছনের মন্দিরে ফিরে যান দেবতারা,ওখান থেকেই লাখো ভক্তকে দর্শন দেন দেবতারা।।ক্ষ্মার্চীর সময় মন্দির চত্বরে বসে
৭দিন ব্যাপী বিশাল মেলা,প্রতিদিন মন্দিরে সমাগম ঘটে লাখো লাখো জাতি উপজাতির ভক্তবৃন্দেরক্ষ্মার্চীতে মন্দিরের ছাদে ভক্তদের বাতাসা লুট দেওয়ার দৃশ্য সত্যি অভূতপূর্ব
ক্ষ্মার্চী ত্রিপুরার জাতীয় উৎসব হিসাবে সরকারী ভাবে স্বীকৃত,শেষের তিনদিন রাজ্যের সমস্ত বিদ্যালয় বন্ধ থাকে,আর অন্যান্য সমস্ত কলেজ- অফিস-কাছাড়িতে ছুটি থাকে শেষের একদিন
পূর্বে নিত্যপুজো ক্ষ্মার্চীর যাবতীয় খরচ বহন করতো ত্রিপুরার মাণিক্য রাজপরিবারকিন্তু ১৯৪৯ সালে ত্রিপুরা ভারতের সাথে মিলিত হবার পর ভারত সরকারের সাথে রাজপরিবারের চুক্তি অনুসারে দেবতাদের নিত্যসেবা,ক্ষ্মার্চী,প্রত্যহ বলির খরচ,মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণ, মন্দির চত্বরে বসা মেলার সমস্ত দায়িত্বভার,পরিচালনা এবং খরচ এখন ভারত সরকারেরক্ষ্মার্চী শেষ হলে দেবতাদের প্রতি রাষ্ট্রীয় সম্মান প্রদর্শন করার পর হর,হরি,উমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় মূলমন্দিরে আর বাকিরা হন বাক্সবন্দীশুরু হয় আবারো এক বছরের প্রতীক্ষারউল্লেখ্য,চৌদ্দ দেবতার কোন সম্পূর্ণ প্রতিমা এখানে নেই,দেবতারা মুণ্ডরূপে পূজিত হন দেবতাদের প্রতিকৃতি রূপে কেবল ১৪ টি মুণ্ড আছে,কোন ধর নেইশুধুমাত্র মহাদেবের প্রতিকৃতির মুণ্ডটি সম্পূর্ণ রজতনির্মিত,বাকি ১৩টি মুণ্ড অষ্টধাতুর

ক্ষ্মার্চীর তাৎপর্য :- ত্রিপুরার লোকবিশ্বাস এই যে ক্ষ্মার্চী চলাকালীন  বৃষ্টি হবেই হবে,এবং প্রকৃতপক্ষে প্রতিবছর তা হয়ওএখন এটা কি আসলেই আলৌকিক ঘটনা নাকি আষাঢ় মাসে হওয়ায় কেবল কাকতালীয় একটা ঘটনা তা যার যার বিশ্বাসের ব্যাপার
বলা হয় অম্বুবাচীতে ধরিত্রী রজঃস্বলা হন,ধরিত্রীকে পুনরায় শুদ্ধ করার জন্য কিছুদিন পরেই আষাঢ় শুক্লাষ্টমীতে ক্ষ্মার্চীর আয়োজন করা হয়

চৌদ্দ দেবতার কথা বললে কের পূজার কথা না বললে অসম্পূর্ণ থেকে যাবেমহারাজ ত্রিলোচনের মহিষী রাণী পদ্মাবতী রাজ্যবাসীর কল্যাণকামনায়, ক্ষ্মার্চী পূজার পরবর্তী কৃষ্ণপক্ষের প্রথম শনিবার কিংবা মঙ্গলবার রাজবাড়ীতে এক বিশেষ পূজার প্রচলন করেন,যা কের পূজা নামে পরিচিত,অনেকে আবার নীরব পূজাও বলেনক্ষ্মার্চী যেমন উৎফুল্লতা,উৎসাহ,আমেজের উৎসব কের তেমনি নীরবতার উৎসবকের পূজাতেও রাজ্যে থাকে সরকারী ছুটি
কের শব্দের বাংলা অর্থ হলো গণ্ডিকের পূজাতে এই গণ্ডি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ পূজার দিন বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে গণ্ডি টানা হয়,এই গন্ডির ভেতরে কেও অশুদ্ধ বস্ত্রে প্রবেশ করতে পারে নাজন্ম,মৃত্যু,অশৌচ এই গণ্ডির ভেতরে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধসম্পূর্ণ নিরবতার সাথে পূজা হয়গণ্ডির ভেতর জোড়ে কথা বলাও নিষিদ্ধরাজ আমলে রাজধানীর বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে বিশাল গণ্ডি পরতো,বর্তমানে শুধু রাজবাড়ীর বাগানে ছোট্ট করে গণ্ডির টানা হয়তবে কেরের গণ্ডি ছোট হলেও ভাঁটা পরেনি পূজার নিয়মে
তথ্যসংগ্রহেঃ শ্রীমান্ জয়দীপ ভট্টাচার্য্য




No comments:

Post a Comment