Tuesday, April 23, 2019

গড়িয়ায় প্রাচীন মা মহামায়া


ঐতিহ্যের ইতিহাসপর্বঃ 

 আজ বনেদীয়ানা' প্রকাশিত হল গড়িয়ায় প্রাচীন মা মহামায়ার ইতিহাস ইতিহাস সংগ্রহ করলেন শ্রীমান্ শুভদীপ এবং শ্রীমান্ সৌমজিৎ বঙ্গের প্রাচীন মন্দিরের মধ্যে এই মহামায়া মন্দিরও অন্তর্ভুক্ত এই মন্দিরের প্রাচীন মৌখিক ইতিহাস এবং লিখিত ইতিহাস দিয়ে সাহায্য করলেন মন্দির প্রতিষ্ঠাতা পরিবারের দুই সদস্যবৃন্দ শ্রী ত্রিনঞ্জন ঘোষাল(কনিষ্ঠ সদস্য) এবং শ্রী শঙ্কর চক্রবর্তী(দৌহিত্র পরিবারের সদস্য)
আলোচনায় আজ মহামায়া' ইতিহাস


দারুময়ী সনাতনী মহামায়া মধ্যযুগে দক্ষিণবঙ্গের ঐতিহাসিক জনপদ ছিল রাজপুর গৌড়বঙ্গের তুর্কিদের আক্রমণে রাজা লক্ষণ সেন পালিয়ে যান যশোরে তাঁর পুত্র আদিগঙ্গা দিয়ে এসে ওঠেন এই রাজপুরে সুদূর অতীতে বর্তমান ত্রিপুরার রাজবংশ এখানে রাজত্ব করতেন বলে কথিত আছে ত্রিপুরাসুন্দরী এই রাজবাড়ির গৃহদেবী প্রবল সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে এই অঞ্চল একসময় প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিনত হয় সেনরাজা সুযোগ্য সেন সেই ত্রিপুরাসুন্দরীর দারুবিগ্রহ নবরূপে প্রতিষ্ঠা করেন বলেই শোনা যায় রাজাদের বসবাস তাই এই স্থানের নাম "রাজপুর" সেনরাজারা রাজকার্যে বৈদিক ব্রাহ্মণদের বিশেষ প্রাধান্য এবং মান্যতাও দিতেন যশোহর এবং নবদ্বীপ থেকে বৈদিক ব্রাহ্মণদের আনা হয়েছিল এই রাজপুরে সেকালে নবদ্বীপ চতুষ্পাঠীতে শাস্ত্র অধ্যায়ন শুরু হত সেখানকার সুপ্রাচীন বিদ্যার অধিষ্ঠাত্রী দেবী পোড়া মা মহামায়ার আশীর্বাদ নিয়েই নবদ্বীপ থেকে আগত ব্রাহ্মণরা সেই ধারা বজায় রাখতে চাইলে সেন রাজ মহামায়ার অনুরূপ এক দারুমূর্তি নির্মাণ প্রতিষ্ঠা করেন রাজপুর এবং সংলগ্ন বোড়ালের এই দুই প্রাচীন এবং বিখ্যাত দারুবিগ্রহ ত্রিপুরাসুন্দরী এবং দেবী মহামায়া মজা গঙ্গার গর্ভে দিঘি খননকালে ত্রিপুরাসুন্দরীর বিনষ্ট দারুবিগ্রহটি উদ্ধার করেন বোড়ালের পত্তনিদার হীরালাল ঘোষ এবং দেবী মহামায়ার মূর্তিটি উদ্ধার করেছিলেন এখানকার জমিদার দুর্গারাম করচৌধুরি এবং পুরোহিত গোরাচাঁদ ঘোষাল দেবীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে তাঁরা যখন ডুব দিয়ে মূর্তিটি তুলে আনেন তখন তাঁরা মূর্তির সাথে পাথরের তিনটি বড় টুকরো পেয়েছিলেন

 ষোড়শ শতাব্দীতে গৌড়েশ্বর হুসেন শাহের পুত্র গিয়াসুদ্দিন মহম্মদ শাহের থেকে রাজপুর সহ বিস্তীর্ণ অঞ্চলের জমিদারি লাভ করেছিলেন কান্যকুব্জ থেকে আগত বিখ্যাত শাণ্ডিল্য গোত্রীয় কায়স্থ হরিপলাশ দত্তের বংশধর কৃষ্ণদাস দত্ত কৃষ্ণদাসের তৃতীয় পুত্র মদন রায় ছিলেন রাজপুরের রাজা মধ্যযুগের বিভিন্ন কাব্য কাহিনীতে তাঁকে নিয়ে নানান কিংবদন্তী রয়েছে তাঁর পৌত্র দুর্গাচরণ রাজবাড়িকে সুরক্ষিত করতে পরিখা নির্মাণ করেছিলেন সেই জন্য গড়িয়া (গড়+ইয়া) স্থানের নামকরণ দুর্গাচরণের পুত্র রাজবল্লভ কম্পানির সনদে রায়চৌধুরী হন রাজবল্লভের সময় কম্পানির চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কারণে তাঁর রাজপুর হরিনাভি গ্রাম দুটি সূর্যাস্ত আইনে নিলাম হয়ে গেলে বারুইপুরে কাছারির নিকট নতুন রাজবাড়িতে উঠে আসেন ইংরেজদের নিমক মহলের দেওয়ান জনার্দন করের পুত্র দুর্গারাম করচৌধুরি তা কিনে রাজপুরে জমিদারির পত্তন করেন

 এই দুর্গারাম করচৌধুরি দানশীল জমিদার ছিলেন গড়িয়া বাসস্ট্যান্ডের কাছে মহামায়াতলায় প্রাচীন মন্দিরের অধিষ্ঠিতা দেবী মহামায়ার নিমকাঠের তৈরি বিগ্রহকে তিনিই উদ্ধার করেছিলেন তিনি উদ্ধার করে মায়ের আটচালা মন্দিরও নির্মাণ করে দেন দুর্গারামের এই মহামায়াকে উদ্ধার নিয়ে শোনা যায় যায় যে, "একদিন দুর্গারাম স্বপ্নে দেখলেন এক দেবী বীণাবাদনরত দুর্গারাম তখন শুনলেন দৈববাণী, 'দুর্গারাম', আমি মহামায়া, গঙ্গার জলে ডুবে আছি আমায় উদ্ধার করে তুই মন্দির প্রতিষ্ঠা কর" স্বপ্নের ঘোরে দুর্গারাম জানতে পারলেন যে দেবী বারহাঁস ফরতাবাদের গঙ্গার ঘাটের কাছেই রয়েছেন তিনি

 পরদিন সকালেই দুর্গারাম নৌকা ভাসিয়ে চলে এলেন ফরতাবাদে বেহুলার ঘাটে গঙ্গার ঘাটে পুরোহিত গোরাচাঁদ ঘোষালের সাথে দেখা কুশল বিনিময়ের পর গোরাচাঁদ ঘোষাল জানতে চাইলেন এত সকালে জমিদারবাবু গঙ্গার ঘাটে কি করছেন উত্তর পেলেন রাতের দেবীর স্বপ্নাদেশ শুনেই তিনি এসেছেন সব শুনে গোরাচাঁদ দুর্গারামকে বললেন তিনিও এই এক দৈববাণী শুনে এসেছেন দুইজনে গঙ্গায় ডুব দিয়ে উদ্ধার করেছিলেন মা মহামায়াকে গঙ্গার পূর্বতীরে বাগানের মধ্যে একটি অস্থায়ী মন্দিরে সেই পাথরের দুটি খণ্ডের উপরে দেবীকে প্রতিষ্ঠা করলেন তাঁরা যার একটি আজও রয়েছে মন্দিরের সামনে তুলসীমঞ্চের পাশে
 ১২১০ সালে(১৮০৩খ্রিঃ) শুভ দিনে নবনির্মিত মন্দিরে দেবী মহামায়াকে প্রতিষ্ঠা করেন জমিদার দুর্গারাম করচৌধুরি(১৭৫৬-১৮১৬) দেবীর অধিষ্ঠানের সূত্রধরেই স্থানের নাম মহামায়াপুর প্রায় ৩৬৫ বিঘা সম্পত্তি দেবোত্তর করে ঘোষাল পরিবারের হাতে দেবীর নিত্যপুজোর দায়িত্ব দিয়েছিলেন জমিদার দুর্গারাম করচৌধুরি বর্তমানে ঘোষালদের দৌহিত্র পরিবার চক্রবর্তীরা দেবীর নিত্যসেবা করেন প্রচলিত কথা এই দেবীরা তিন বোন গড়িয়ার এই প্রাচীন মা মহামায়া, বোড়ালের সেন রাজাদের মা ত্রিঁপুরসুন্দরী এবং টালিগঞ্জের সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবারের মা করুণাময়ী মন্দিরের সামনে দিয়ে প্রবাহিত আদিগঙ্গা কথিত আছে, তিন বোন তখন গঙ্গার ঘাটে বসে এক শাঁখারিকে দেখে তাঁরা শাঁখা পরতে চাইলেন শাঁখা পরিয়ে পয়সা চাইলে তাঁরা বলেন কাছেই তাঁদের বাড়ি তাঁদের বাবা ওই মহামায়া মন্দিরের পূজারি মন্দিরের কুলঙ্গিতে কৌটোতে পয়সা আছে, গিয়ে বললেই দিয়ে দেবেন এই সমস্ত কথা শাঁখারি যখন ঘোষাল পরিবারের পূজারিকে বলেন তখন তিনি অবাক হয়ে যান সেই তথ্য পরীক্ষা করতে গিয়ে মন্দিরের দ্বার খুলে তিনি তো অবাক হন মায়ের দুইহাতে নতুন শাঁখা পাশেই কুলুঙ্গি হাত বাড়িয়ে পয়সার কৌটো বার করে তিনি যা দেখলেন তাতে তিনি বাকরুদ্ধ সেখানে একটি রুপোর টাকা রয়েছে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলেন মায়ের মুখে ছলনার মৃদুহাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন মা মহামায়া

 শ্রী শঙ্কর বাবু বললেন ২৩শে জানুয়ারি দেবীর বাৎসরিক পূজা সেই দিনে বহু ভক্তের সমাগম ঘটে প্রতিদিনিই দেবীকে অন্নভোগ নিবেদন করা হয়, মহামায়া মাছভোগ গ্রহণ করেন আগে বলিদান প্রথা ছিল বর্তমানে তা বন্ধ ঘোষাল পরিবারের সদস্য বলেন বর্তমানে ঘোষাল পরিবার এবং তাঁদের দুই দৌহিত্র পরিবারে পাল হয় তিনমাস করে দেবীর মন্দিরে এছাড়া মন্দির কমিটিও তৈরি করা হয়েছে, তারা বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজও করছেন মন্দিরে বিশেষ দিনে দেবীকে খিঁচুড়ি, সাদাভাত, ভাজা, নানান রকমের তরকারি এবং মাছ দেওয়া হয় মহামায়া মন্দিরের আরও একটি বিশেষ পূজা হল নীলপুজো সেই দিন বহু ভক্তসমাগম ঘটে এই মন্দিরে ভক্তরা এই একদিন দেবীকে প্রণাম করতে পারেন

 এইভাবে প্রায় ৩৫০বছরের প্রাচীন মা মহামায়ার মন্দির তার ধারাবাহিকতা এবং ঐতিহ্য বহন করে আসছে, দেবীর এই শান্তরূপ সত্যই যেন মা মহামায়া
কৃতজ্ঞতাস্বীকারঃ শ্রী শঙ্কর চক্রবর্তী এবং শ্রী ত্রিনঞ্জন ঘোষাল
তথ্যসংগ্রহেঃ শ্রীমান্ শুভদীপ রায় চৌধুরী এবং সৌমজিৎ মাইতি


No comments:

Post a Comment