ঐতিহ্যের
ইতিহাসপর্বঃ
আজ বনেদীয়ানা'য়
প্রকাশিত হল সদস্য শ্রীমান্
শঙ্খ'র ময়নাগড় রাজবাড়ির
ইতিহাস। ইতিহাসের
সন্ধানে আজ শঙ্খ, সঙ্গে
বনেদীয়ানা পরিবার
ময়নাগড়
রাজবাড়ী। পূর্ব
মেদিনীপুর।
"ময়না
রাজার মান,
গজনা রাজার ধান।
কুচল ঘড়ুইয়ের পাকা,
দে নন্দের টাকা।।"
প্রবাদ-প্রবচন যেমনতেমন।
সে তো, এককালের অভিজাত
পরিবার মাত্রই তাদেরকে কেন্দ্র
করে স্থানীয়দের মধ্যে কিছু না
কিছু ছড়া বা প্রবচন
মুখে মুখেই প্রচলিত হ'তো। কিন্তু,
ময়না রাজবংশ শুধু প্রবাদেই
নিজের অস্তিত্ব স্বীকার করে যায়নি; সঙ্গে
কিংবদন্তী, ইতিহাস ও মঙ্গলকাব্য
প্রসঙ্গে বারবার ধরা দিয়েছে। ময়নার
রাজারা, নাকি চিরকালই অভিজাত। এঁদেরই
রাজধানীর, ময়নাগড়।
নগেন্দ্রনাথ
বসু তাঁর "বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস
গ্রন্থ"-এ স্বীকার করেছেন
যে, ময়নাগড় একসময়ে "ধর্মমঙ্গল
কাব্যগ্রন্থ"-এর 'লাউসেন'-এর
রাজধানী ছিলো। শুধু
মঙ্গলকাব্যই নয়, লাউসেনের সঙ্গে
ঐতিহাসিক প্রসঙ্গও ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। গৌড়েশ্বর
ধর্ম্মপালের সেনাপতি কর্ণসেনের পুত্র ছিলেন এই
লাউসেন। কিংবদন্তী
অনুসারে ধর্মঠাকুরের কৃপায় লাউসেন নাকি
এই ময়নাগড়েই পশ্চিমদিকে সূর্য্যোদয় দেখিয়েছিলেন। এপ্রসঙ্গ
বাদে ইতিহাসের ভিত্তিতে জানা যায়, লাউসেনের
পরবর্তীতে পরিত্যক্ত ময়নাগড় জনৈক জলদস্যু
শ্রীধর হুইয়ের দখলে যায়।
উৎকলরাজ
কপিলিন্দ্রদেবের রাজত্বকালে তাঁর অন্যতম সামন্তরাজ
কালিন্দিরাম সামন্ত কেলেঘাই নদীর
তীরবর্তী বালিসিতাগড়ের সামন্তরূপে রাজত্ব করতেন।
কালিন্দিরামের অধঃস্তন পঞ্চমপুরুষ গোবর্ধনানন্দ, জলদস্যু শ্রীধর হুইকে পরাজিত
করে ময়নাগড় দখল করেন। পরবর্তীতে
আনুমানিক ১৫৬২ খ্রীস্টাব্দে এখানে
সামন্তরাজ পরিবার স্থাপন করেন। সেই
সময়ে উৎকলের সিংহাসনে কপিলিন্দ্রদেবের
উত্তরপুরুষ মহারাজ হরিচন্দন অধিষ্ঠিত। ময়নাগড়
দখলের পরে, সামন্তরাজ গোবর্ধন
উৎকলরাজ'কে খাজনা দেওয়া
বন্ধ করলে হরিচন্দন অতর্কিতে
যুদ্ধ ঘোষণা করেন।
সেসময়ে গোবর্ধন বাস করছিলেন বালিসিতাগড়ের
বসতবাটীতে। একে
অতর্কিতভাবে আক্রমণের দাপট অন্যদিকে স্বল্পসৈনবল....
বীরসুলভ যুদ্ধ করেও তিনি
পরাজিত ও বন্দি হ'ন। রাজপ্রাসাদের
অদূরে বন্দিশালায় আবদ্ধ থাকাকালীন সঙ্গিতরসিক
গোবর্ধনের মৃদুমন্দ সুরভাঁজার কথা উৎকলরাজের কানে
পৌঁছায়। তিনি
সশরীরে শোনার জন্য ছদ্মবেশে
কারাগারে আসেন। মন্ত্রমুগ্ধ
হয়ে যান গোবর্ধনের সুরমূর্চ্ছনা
আর গায়কী ভঙ্গীতে।
অতঃ তিনি সামন্তরাজকে মুক্ত
করেন এবং এই বীরযোদ্ধাকে
রাজসম্মান স্বরূপ সিংহাসন, রাজছত্র,
চামড়, বাণ, ডঙ্কা, রাজচিহ্ন,
যজ্ঞ-উপবিত এবং 'বাহুবলীন্দ্র'
উপাধি দান করেন।
সঙ্গে সঙ্গে, বালিসিতাগড় তথা
অধিকৃত ময়নাগড়কে স্বাধীন রাজত্ব রূপে ঘোষণা
করেন।
এখন ময়নাগড়ে বাহুবলীন্দ্র গেবর্ধন প্রতিষ্ঠিত প্রাচীন রাজবাড়ীর ধ্বংসাবশেষ দেখা যায় মাত্র!
একটু বিচক্ষণ নজরে লক্ষ্য করলেই
দেখা যায়, রাজপ্রাসাদ নির্মাণে
বৌদ্ধ এবং উড়িষ্যা স্থাপত্যরীতির
যৌথ শৈল্পিক নিদর্শন। তারও
পরবর্তীকালে বিভিন্ন মহারাজের আমলে যেসব মহল
নির্মাণ করিয়ে রাজপ্রাসাদের পরিসর
বাড়ানো হয়েছে, সেগুলিতে বিভিন্ন
সময়োপযোগী শিল্পরীতির সুস্পষ্ট ইঙ্গিত। বঙ্গীয়
ঘরানার দালানকোঠা থেকে শুরু করে
রোমান স্থাপত্যের কারুকার্য্যমণ্ডিত ফ্রেস্কো, থামের অলঙ্করণ, রাজবাড়ীর
ছাদের গঠনশৈলী... কী নেই! বাড়ীটির
বেশীরভাগ কক্ষই এখন প্রবেশের
অযোগ্য, ধ্বংসাবশেষ বৈ কিছু না!
প্রাসাদের একদিকেই বসবাসযোগ্য কিছুটা অংশে বর্তমানে
থাকেন মহারাজ প্রণব বাহুবলীন্দ্রের
বংশধরগণ। এই
অংশের পূর্বদিকে যেটি রাজআমলে দরবারকক্ষ
হিসাবে পরিগণিত হ'তো, এখন
সেখানে বিভিন্ন সাহিত্য সম্মেলন বা সাংস্কৃতিক সমাবেশের
আয়োজন করা হয়।
ধ্বংসাবশেষ থেকে বাসযোগ্য অংশটি
সংস্করণের সময়ে ভূগর্ভস্থ আরেকটি
প্রাসাদ বেড়িয়ে আসে!! রাজপুরুষেরা
কেউ জানতেনই না যে, তাঁদের
ভূপৃষ্ঠস্থ বসতবাড়ীর নীচে ভূগর্ভস্থ আরও
একটি প্রাসাদ লুকিয়ে আছে!! সেখান
থেকে বহু রহস্যময় প্রত্নতাত্ত্বিক
নিদর্শন ও পালযুগীয় বৌদ্ধ
শিল্পরীতির বহু নমুনা উদ্ধার
হওয়ায় এটা রাজপরিবারের সদস্যরা
মেনে নেন যে, ঐ
গুপ্ত প্রাসাদটি আদতে 'লাউসেন' প্রতিষ্ঠিত
প্রাসাদের অংশ।
যাইহোক,
গোবর্ধন বাহুবলীন্দ্র প্রসঙ্গে আসা যাক।
জলদস্যুর হাত থেকে ময়নাগড়
উদ্ধারের পরে সামন্তরাজ গোবর্ধন
মূল বসতবাড়ীটি কেন্দ্র করে চারদিকে দ্বিস্তরীয়
ধাঁচে গভীর পরিখা খনন
করান। অর্থাৎ,
দ্বীপে অবস্থিত মূল রাজবাড়ীটি দু'টি পৃথক বর্গাকার
পরিখা দ্বারা বেষ্টিত।
এই পরিখা দুটি কালীদহ
ও মাকড়দহ নামে পরিচিত। গড়বাড়ী
সংলগ্ন পরিখা, কালীদহের একপাশের
দৈর্ঘ্য ৭৫০ ফিট অর্থাৎ,
গড়সমেত কালীদহের পরিমাপ ৫,৬২,৫০০ বর্গফিট।
এর বাইরের পরিখা অর্থাৎ,
মাকড়দহের একপাশের দৈর্ঘ্য ১,৪০০ ফিট। তাহলে
সর্বমোট মাকড়দহ, কালীদহ সমেত গড়বাড়ীর
জমির মাপ ১৯,৬০,০০০ বর্গফিট বা
৩০৭ বিঘা। সম্পূর্ণ
গড়প্রাসাদটি কংসাবতীর মূলধারার সঙ্গে যুক্ত।
গড়ের ভিতরে বিভিন্ন সময়ে
প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন মন্দিরগুলির মধ্যে পনেরো শতাব্দীতে
নির্মিত শ্রী শ্রী শ্যামসুন্দর
জিউ মন্দির এবং ষোড়শ
শতকের লোকেশ্বর জিউ মন্দির উল্লেখযোগ্য। বর্তমানে
লোকেশ্বর জিউয়ের গর্ভগৃহে বৌদ্ধ
দেবী 'রঙ্কিণী'-র একটি প্রাচীন
বিগ্রহ দেখা যায়।
অনুমানসাপেক্ষে বলা যায়, এই
বিগ্রহটি লাউসেন পূজিত।
এছাড়াও, কালীদহ এবং মাকড়দহের
মধ্যবর্তী অংশে দশম শতাব্দীতে
নির্মিত কয়েকটি বৌদ্ধ পীঠস্থানও
রয়েছে। শ্যামসুন্দর
জিউয়ের মন্দিরটি এককথায় অপূর্ব শিল্পসুষমা
মণ্ডিত। টেরাকোটার
অলঙ্করণে সমৃদ্ধ শ্যামসুন্দর মন্দিরে
বিগ্রহের নিত্য আরাধনা ও
সেবাপূজা চলার সাথে সাথে
মন্দিরেরও যথেষ্ট রক্ষণাবেক্ষণ হয়,
তা দেখলেই বোঝা যায়। মন্দিরের
একপাশে সতীরাণীর ঘাট। রাসোৎসবের
সময়ে এই ঘাটেই নৌকা
বেঁধে শ্যামসুন্দর ও রাধারাণীকে নিয়ে
যাওয়া হয় পরিখার মধ্যবর্তী
আরেকটি দ্বীপে, যেখানে রাসমণ্ডপ প্রতিষ্ঠিত
রয়েছে। রাসপূর্ণিমার
রাতে সারসার আলোকসজ্জিত নৌকায়
শ্যামসুন্দর যখন পরিখায় জলকেলি
করতে নামেন, তখন সে
দৃশ্য সত্যিই অভাবনীয়! যেন
সত্যিই বৃন্দাবনলীলার সহসা আবির্ভাব হয়,
ময়না রাজাদের কালীদহের জলে! কংসাবতীর জল
যেন এক অজানা মোহময়তায়
সেজে ওঠে। রাজত্বকাল
থাকাকালীন শ্যামসুন্দরের সাংবাৎসরিক ব্যয় রাজকোষ থেকেই
নির্বাহ হতো। এখন
পারিবারিক সদস্যদের পাশাপাশি সর্বসাধারণের অর্থানুকূল্যে তা নির্বাহ হয়। সর্বোপরি,
এখানকার রাসমেলায় সূচনালগ্ন থেকেই হিন্দুজাতির পাশাপাশি
মুসলমান ধর্মাবলম্বীদেরও প্রত্যক্ষ উপস্থিতি ও সহযোগিতা অবশ্যই
লক্ষ্যনীয়। রাজআমলে
হিন্দু-মুসলমান ধর্মীয় সম্প্রীতি বজায়
রাখার উদ্দেশ্যেই একসময়ে দুই ধর্মগুরু
যথাঃ বৈষ্ণব মহান্ত নয়নানন্দ
এবং মুসলমান ফকির হজরুত-তুল
জালালের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় এই রাসোৎসবকেই কেন্দ্র
করেই ধর্মীয় বাধানিষেধের যাবতীয়
ব্যবধান দূর করা হয়। বর্তমানে
কালীদহের গা-ঘেঁষে গড়ের
পূর্বদিকে নয়নানন্দ এবং উত্তরদিকে হরজত
জালালের সমাধিমন্দির বর্তমান।
লোকেশ্বর জিউয়ের লিঙ্গমূর্তিটি নাকি
সয়ম্ভূ। তাঁর
সাথে পূর্বোল্লিখত দেবী রঙ্কিণী এখানে
দেবী ভদ্রকালী রূপে নিত্যপূজিতা হচ্ছেন। লোকেশ্বর
মন্দিরের বাইরের প্রস্তরখন্ডের উপরে
একটি শাঁখ প্রোথিত আছে। এটি
'সূর্য্যশঙ্খ' নামে পরিচিত।
আগে রাজআমলে মহারাজরা নিত্য সূর্য্যার্ঘ্য নিবেদনের
জন্য এই সূর্য্যশঙ্খেই পূজা
করতেন।
গোবর্ধন
বাহুবলীন্দ্রের পরবর্তী রাজা ছিলেন একজন
পুত্র পরমানন্দ বাহুবলীন্দ্র। তিনি
পরমানন্দপুর নামক একটি গ্রাম
পত্তন করেন এবং শ্রীকৃষ্ণরায়
নামক বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করে
স্থানীয় ব্রাহ্মণকূলে প্রচুর দেবোত্তর ও
ব্রহ্মোত্তর ভূসম্পত্তি দান করেন।
মুঘলসম্রাট জাহাঙ্গীর পরমানন্দ বাহুবলীন্দ্র'কে বাদশাহী প্রতীক
'পাঞ্জা' প্রদান করেন।
তাঁর পুত্র মাধবানন্দের রাজত্বকালে
বাঙলার অধিকার শায়েস্তা খাঁ'য়ের অধীনে যায়।
এককথায়,
গোবর্ধন বাহুবলীন্দ্রের পরবর্তী দশপুরুষ প্রবল প্রতাপে রাজত্ব
করে যান। মহারাজ
জগদানন্দ(১৭৭০খ্রীঃ - ১৭৭৩খ্রীঃ)-এর রাজত্বকালে ময়নাগড়
রাজত্ব ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির
হস্তগত হয়। জগদানন্দের
সঙ্গে কোম্পানির লড়াইয়ের সময়ে লেফটেন্যান্ট রবার্ট
বেইলির নেতৃত্বে ইংরেজ সেনা গড়
আক্রমণ করে। কিন্তু
সুরঙ্গপথে রাজা অন্যত্র চলে
যাওয়ায় ইংরেজরা কেউই রাজার খোঁজ
পায়নি। পরিবর্তে,
রবার্ট বেইলির নেতৃত্বে প্রাসাদে
যথেচ্ছ ভাঙচুর এবং লুটতরাজ
চালানো হয়। রাজা
জগদানন্দের রাজত্বকালেই ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের ভয়াবহতা বাঙলাকে গ্রাস করে ফেলে। সেই
সময়ে ইংরেজদের নজর এড়িয়ে গোপনে
থেকেও রাজা জগদানন্দের দান-ধ্যান-আশ্রয়ের কথা
আজও রাজবংশের ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিখিত। তাঁর
পুত্র মহারাজ ব্রজানন্দের রাজত্বকালেই
ওয়ারেন হেস্টিংস 'পাঁচসালা' এবং লর্ড কর্ণওয়ালিস
'দশসালা' ব্যবস্থার সূচনা করেন।
১৭৯১ খ্রীস্টাব্দে ইংরেজসরকার, ময়নাগড় রাজাদের সঙ্গে
বিশ্বাসঘাতকতা করে ও মিথ্যা
প্ররোচনায় তাঁদের জর্জরিত করে
মাত্র "দেড় টাকা" খাজনা
আনাদায়ে(কর ফাঁকি দেওয়ার
দায়ে) তৎকালীন আমলে প্রায়, শতাধিক
বিঘা জমি এবং পরগণার
প্রায় ৫৬টি গ্রাম ইংরেজরা
বলপূর্বক হস্তক্ষেপ করে নেয়! রাজা
ব্রজানন্দের মৃত্যুর পরে অবশিষ্ট ১০৫টি
পরগণা সমন্বিত ময়নাগড় রাজত্ব বহু
ছোটো ছোটো জমিদারী ও
জায়গীরদারিতে বিভক্ত হয়ে যায়।
রাজা পূর্ণানন্দ বাহুবলীন্দ্র(১৮৬৩খ্রীঃ - ১৯৩৭খ্রীঃ)-এর রাজত্বকালে অসহযোগ
আন্দোলনের সূচনা হয়।
ময়নাগড়েও তার প্রভাব এসে
পড়ে। রাজা
নিজেও স্বাধীনতা সংগ্রামে জড়িয়ে পড়েন।
ময়নাকে কেন্দ্র করে সেবক সমিতি
গঠন করা হয়।
বহু স্বাধীনতা সংগ্রামীর এককালীন গোপন আস্তানা রূপে
পূর্ব পর্বোল্লিখিত নাড়াজোল রাজবাড়ীর মতো ময়নাগড় রাজবাড়ীও
পরিগণিত হতো। পরিখাঘেরা
দ্বিগুণ সুরক্ষার কারণে বহুবার বহু
দেশভক্ত বিপ্লবী এই রাজবাড়ীতে আশ্রয়
নিয়েছেন। দিনের
পর দিন চলেছে সংগ্রামীদের
অস্ত্র-প্রশিক্ষণ, সভার কার্য্যকলাপ।
রাজা পূর্ণানন্দ বাহুবলীন্দ্রের বংশধর হেরম্বানন্দের আমলেই
বাহুবলীন্দ্র পরিবার বিভিন্ন শরিকানায়
বিভক্ত হয়ে যায়।
ময়নার
রাজপরিবার বাহুবলীন্দ্র বংশের বাসস্থান হিসাবেও
যেমন ময়নাগড়ের গুরুত্ব রয়েছে, তেমনই এর
গুরুত্ব ইতিহাস, মঙ্গলকাব্য, প্রবাদপ্রবচন সর্বত্র। পরিখাবেষ্টিত
এই গড়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যও
আকর্ষণীয়। এই
ঐতিহাসিক গুরুত্বের কারণেই ময়নাগড়কে ২০০৬
সালে রাজ্য হেরিটেজ কমিশনের
তরফ থেকে "হেরিটেজ সাইট"-এর তকমা দেওয়া
হয়। যদিও
হেরিটেজ সাইটের স্বীকৃতি পেলেও
আজ অব্দি ইতিহাস সংরক্ষণ
সংক্রান্ত কোনো কাজই করা
হয়নি বলে রাজপরিবার বা
স্থানীয়দের তরফে অভিযোগও রয়েছে!
যদিও সরকারি তরফের বক্তব্য
অনুসারে, এই জায়গাটিকে কেন্দ্র
করে বহুমাত্রিক ভ্রমনস্থানের পরিকল্পনা নাকি গৃহীত হয়েছে!
শুধু রূপায়ণের অপেক্ষা! বর্তমানে ময়নাগড়ে রাজবাড়ীর প্রাচীন অংশটি ভেঙে পড়লেও
কিছুটা অংশ সংস্করণ করে
বসবাসযোগ্য করা হয়েছে।
সঙ্গে কয়েকজন শরিকানা বিভক্ত
উত্তরসূরীদেরও বসতি নির্মিত হয়েছে। বংশীধারী
শ্যামসুন্দর আজও ঐতিহাসিক রাজবংশের
সুমহান ইতিহাসের একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী হয়ে শ্রীমতি রাধিকার
সঙ্গে নিত্যপূজিত হচ্ছেন। দিনেরাতে
ঘন্টাধ্বনি, কীর্তনশব্দে মন্দির আঙিনা মুখরিত
হয়। তবুও
কী যেন একটা নেই...
এমন মনে হয় কেন!!
মঙ্গলকাব্যের
প্রতি পঙ্কতিতে বা গৌড়েশ্বরের লুপ্ত
রাজত্বকালের সাক্ষী হিসাবে কিংবা
উৎকলরাজের সুমহান দানে সমৃদ্ধ
ময়নাগড় রাজবাড়ী নিজেই নিজের দুর্ভেদ্য
প্রাচীরের প্রতি রন্ধ্রে রন্ধ্রে
এক অশ্রুতপূর্ব বীরগাথা রচনা করে চলেছে। পরিখায়
কত জল বয়ে গেলো,
কত রাজার পালাবদল হ'লো, কত বিদেশী-বিভুঁয়দের আক্রমণে রাজবংশ জর্জরিত হলো...
সে হিসাব কি কেউ
রেখেছে! কালের গ্রাসে আর
বৈদেশিক শক্তির হামলায় আজ
বেশীরভাগ ঐতিহ্য, সাবেকিয়ানা, রাজপদমর্যাদা, দৃষ্টি নান্দনিক স্থাপত্যকর্ম...
ধ্বংস হয়েছে! আর যেটুকু
বাকী আছে, তার নীরব
সাক্ষী রূপে দাঁড়িয়ে আছেন
কুলদেবতা শ্যামসুন্দর জিউ, লোকেশ্বর জিউ
এবং কুলদেবী রঙ্কিণী মাতা। তাঁদের
সভাপার্ষদের ভূমিকায় রয়েছেন বৌদ্ধযুগের কিছু
দেবদেবীর ভগ্নপ্রায় বিগ্রহ, ধর্মঠাকুরের বেদী, বৈষ্ণব মহান্তের
সমাধি আর হজরত জালালের
পীরতলা! তাই একথা বলাই
যায়, ময়নাগড় শুধুমাত্র ঐতিহাসিক
নিদর্শন হিসাবেই নয়; মঙ্গলকাব্যের প্রতিছত্রে,
ধর্মীয় সম্প্রীতির পীঠস্থানরূপে বরাবর স্বমহিমায় বিরাজমান
হয়ে থাকবে।
তথ্যসূত্রঃ
শ্রীমান্ শঙ্খ
No comments:
Post a Comment