Saturday, April 13, 2019

বড়িশা সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবারের অন্নপূর্ণাপূজা


অনুষ্ঠিত হয়ে গেল বড়িশা সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবারের অন্নপূর্ণাপূজা, বড়বাড়িতে সাড়ম্বরে পালিত হল শ্রীশ্রীঅন্নপূর্ণা মাতাঠাকুরাণীর পূজা সেই পুজোর সাক্ষী থাকল বনেদীয়ানা পরিবারের সদস্যরা
রায় চৌধুরী পরিবারের অন্নপূর্ণাপূজাঃ


 সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবার সমগ্র বাংলার সামাজিক ইতিহাসে এক বিশেষ স্বতন্ত্র স্থান অধিকার করে রয়েছে এই পরিবারের ইতিহাসের সূচনা হয় খ্রীষ্টীয় দশম শতকে যখন বাংলার শাসনকর্তা মহারাজ আদিশূর কনৌজ হতে পাঁচজন বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণকে রাঢ়-বঙ্গে নিয়ে আসেন সনাতন ধর্ম পুনরায় প্রবর্তন করার জন্য সাবর্ণ পরিবারের আদি পুরুষ মহামতী বেদগর্ভ এই পঞ্চব্রাহ্মণের অন্যতম কালীঘাটের সাথেও এই পরিবারের ঘনিষ্ঠতা নিবিড় প্রাচীন কালীঘাটের দেবী কালিকাই হলেন এই পরিবারের কুলদেবী সন্তোষ রায় চৌধুরী তাঁর মৃত্যুর আগে কালীর বর্তমান মন্দির নির্মাণ শুরু করেন যা তাঁর সুযোগ্য উত্তরসূরি রাজীবলোচন রায় চৌধুরী ১৮০৯সালে শেষ করেন তখনকার দিনে ব্যয় হয়েছিল তিরিশ হাজার টাকা নিশ্চিত ভাবে বলা যেতে পারে যে কালীর পীঠস্থানকে কেন্দ্র করেই এই শহর-সভ্যতা-সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে এবং 'কলকাতা' নামের উৎপত্তিও এখান থেকেই সাবর্ণ পরিবারের দ্বিবিংশতিতম পুরুষ প্রথম জমিদার রায় লক্ষ্মীকান্ত মজুমদার চৌধুরী কোন সাধারণ ভূস্বামী ছিলেন না মনে রাখতে হবে যে, বাংলার তৎকালীন শাসক(রাজপ্রতিনিধি) ক্ষত্রিয়কুলশিরোমণি মহারাজ মানসিংহ তাঁকে সুবেদার করতে চাইলে, ব্রাহ্মণ সন্তান লক্ষ্মীকান্ত ক্ষত্রিয়ের কর্ম গ্রহণে অস্বীকৃত হয়েছিলেন লক্ষ্মীকান্ত ছিলেন বিশাল এক নিষ্কর জায়গীরের একছত্র অধিপতি তৎকালীন বাংলা সুবার(বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা) এক-পঞ্চমাংশ ভূমির রাজস্ব আদায়ের দায়িত্বও তাঁর ওপর ছিল বর্তমানে দেশের এই প্রান্তে যে সভ্যতা, সমাজ সংস্কৃতির জয়পতাকা উড়ছে লক্ষ্মীকান্তকে একক ভাবে তার জনক বললে নেহাতই অনুচিত অনৈতিক হবে না লক্ষ্মীকান্ত প্রবর্তিত আটচালার দুর্গোৎসব বাংলাদেশের সপরিবার শ্রীদুর্গার প্রতিমা-পূজার প্রাচীনতম নিদর্শন বর্তমানে তা চার শতাব্দীর ঐতিহ্য বহন করে চলেছে বড় বাড়ী কালিকিঙ্কর ভবনের দুর্গাপুজোও শোভাবাজার রাজবাড়ীর পূজাদ্বয়ের থেকেও প্রাচীন

"লক্ষ্মীকান্তং কমলনয়নং যোগিভির্ধ্যানগম্যম্
বন্দে বিষ্ণুং ভবভয়হরং সর্ব্বলোকৈকনাথম্।।"
 এবার বলা যাক রায় চৌধুরী পরিবারের বড় বাড়ীর কথা নন্দদুলাল রায় চৌধুরীর বড় ছেলে রাঘবেন্দ্র পাকাপাকি ভাবে এইখানে বসবাস করলেন রাঘবেন্দ্রই হলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি 'বড়িশাধিপতি' খেতাব ব্যবহার শুরু করেন রাঘবেন্দ্রের একমাত্র সন্তান হলেন তারিণীচরণ আর এই পিতা-পুত্রের সময় বড় বাড়ীর দুর্গোৎসব রথযাত্রা আরও খ্যাতি ব্যাপকতা অর্জন করেন তারিণীচরণ অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে বড় বাড়ীর উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে এক বাজার বসান আগে ছিল সাপ্তাহিক হাট প্রজাদের প্রয়োজনে এলাকার ব্যবসাকে সমৃদ্ধিশালী করার জন্য তা হল নিয়মিত বাজার জমিদারের খেয়ালে বাজার; তাই নাম 'সখের বাজার' তারিণীচরণের মোট আট ছেলে কিন্তু তাদের মধ্যে শুধু রামকুমার, কালীকান্ত চন্দ্রকান্তের বংশ রক্ষা পেয়েছিল এবং এঁদের বংশধরগণ বড় বাড়ীতে বসবাস করতেন এঁরা প্রত্যেকেই মূল বসতবাড়ীর বিভিন্ন প্রান্তে নিজেদের জন্য অট্টালিকা তৈরী করেন চন্দ্রকান্ত দুইবার বিয়ে করেছিলেন তবুও তাঁর কোন সন্তান না হওয়ায় তিনি সাবর্ণ পাড়ার যদুনাথ রায় চৌধুরীর তৃতীয় পুত্র রাজেন্দ্রকুমারকে দত্তক নেন রাজেন্দ্রকুমার সাবালকত্ব অর্জন করলে উত্তর কলকাতার বনেদী বাড়ীর এক সুন্দরী মেয়ে চন্দনবালা দেবীর সাথে তাঁর বিয়ে হয় হারাধন(হরিধন) নামে তাঁদের এক ছেলে হয় কিন্ত কয়েক বছর বাদে সেও মারা যায় নিজের বংশ লোপ আশঙ্কায় চন্দ্রকান্ত বিমর্ষ হয়ে পড়েন তার ওপর তাঁর দুই স্ত্রী স্বামীর মৃত্যুর পর কাশীবাসী হবার সিদ্ধান্ত নেন তাঁদের নিরস্ত করতেই আনুমানিক ১৮৫০-৬০ সাল নাগাদ চন্দ্রকান্ত তাঁর নবনির্মিত বাড়ীর উঠোনে মা অন্নপূর্ণার এক পঞ্চরত্ন মন্দির জোড়া শিব মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন

মৃত্যুর আগে তিনি উইল করে তাঁর সমস্ত সম্পত্তি স্থাবর অস্থাবর বিষয় সম্পত্তি মা অন্নপূর্ণার নিত্য সেবাপুজোর জন্য দান করেন এবং দুই পত্নী বিন্দুবাসিনী দেবী গনেশজননী দেবীকে উক্ত দেবত্তর সম্পত্তির তত্ত্বাবধায়িকা নির্বাহিকা নিযুক্ত করে যান চন্দ্রকান্ত প্রতিষ্ঠিত ৩০০ভরি ওজনের সোনার অন্নপূর্ণা বিগ্রহ ১৯৫৬ সালে মন্দির থেকে চুরি হয়ে যায় কিন্তু প্রায় ১মন ওজনের রজত-নির্মিত শিব বিগ্রহটি আজও বর্তমান ১৯৫৬ সালে তাঁরাকুমার রায় চৌধুরীর বংশধররা জরাজীর্ণগ্রস্ত পুরোনো মন্দিরটি ভেঙে ফেলে সেখানে নতুন মন্দির নির্মাণ করে অষ্টধাতুর অন্নপূর্ণা বিগ্রহ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন



 প্রতিবছরই শ্রীশ্রীঅন্নপূর্ণা মাতাঠাকুরাণীর বাৎসরিক পূজা মহাসমারহে অনুষ্ঠিত হয় বড় বাড়ীতে সকালে মঙ্গলারতি হয় তারপর অন্নপূর্ণা পূজা হয় বহু ভক্তের সমাগম ঘটে এই মন্দিরে কলকাতা শহরে এমন প্রাচীন মন্দির খুবই বিরল অন্নপূর্ণা পূজার দিন দেবীকে দশ রকমের মাছ, দশ রকমের তরকারি, সাদাভাত, পোলাও, খিঁচুড়ি, পায়েস, দই, নানান রকমের মিষ্টান্ন প্রদান করা হয় রায় চৌধুরী পরিবারে সেইদিন মন্দিরে অন্নকূট উৎসব অনুষ্ঠিত হয়, প্রায় একশো কেজি চালের অন্নকূট হয় পূজার দিন এছাড়া বলিদানের প্রথাও রয়েছে এই পরিবারে রাত্রে নিত্য-গীত-বাদ্যাদি রাগসেবা হয় মন্দিরে এছাড়া শ্রীশ্রীদেবীমাহাত্ম্য পাঠ ১০৮দীপদান প্রথাও রয়েছে সাবর্ণ পরিবারে



সারাদিন বহু ভক্তের সমাগম হয় এই প্রাচীন মন্দিরে কলকাতার প্রাচীনতম অন্নপূর্ণা ঠাকুরানীর মন্দির এই বড়িশায় সাবর্ণদের বড় বাড়িতে
তথ্যসংগ্রহেঃ শ্রীমান্ শুভদীপ রায় চৌধুরী
চিত্রঋণঃ শ্রীমান্ শুভদীপ রায় চৌধুরী




No comments:

Post a Comment