ঐতিহ্যের
ইতিহাসপর্বঃ
আজ "বনেদীর-বনেদীয়ানা"তে
প্রকাশিত হল শ্রীমতী দেবযানী
বসুর "বনেদী বাড়ির বাসন্তী
পূজার" প্রথমপর্ব। আজ
নিবারণচন্দ্র দত্ত বাড়ির পুজো।
বাংলার প্রকৃতিতে শেষ
চৈত্রের বাতাবরণ। বসন্তের
মৃদুতা, গাছে গাছে কিশলয়ের
হিল্লোল, পলাশের রক্তিমাভা আর
তার মাঝে ঢাক-কাঁসরের
বোল। বছর
শেষে আবার আগমনীর সুর। কুমোর,
বাজনাদার, মণ্ডবি, পুরোহিত-সবারই চূড়ান্ত ব্যস্ততা। মা
জগন্ময়ী আসছেন যে বাসন্তী
দুর্গা রূপে ঠাকুরদালান আলো
করে; শরৎকালের অকালবোধন নয়, বাসন্তী দুর্গার
আরাধনা হল শাস্ত্রমতে সত্যিকার
মাতৃ আরাধনা। ত্রেতাযুগে
ভগবান রামচন্দ্রের দুর্গাবন্দনার মধ্য দিয়ে শারদীয়া
পুজোর সূচনা হলেও বহু
আগে থেকেই বাংলা তথা
ভারতবর্ষে বসন্তকালে শক্তিপূজার প্রচলন ছিল।
দক্ষিণ ২৪ পরগণার
আমতলা থেকে চড়িয়াল পর্যন্ত
রাস্তাটি হল নিবারণ চন্দ্র
দত্ত রোড। এই
রাস্তায় বাখরাহাট স্কুল স্টপে নামলেই
কানে আসবে দত্তবাড়ির ১২২বছরের
বাসন্তী পুজোর সমারোহ।
বিশাল এলাকা নিয়ে কালাচাঁদ
দত্ত ভবন। তাঁর
পুত্র নিবারণ চন্দ্র দত্ত। পূর্বে
খাসঠিকা এবং জয়চণ্ডীপুর ছিল
দুটি লাগোয়া গ্রাম।
বাবার মৃত্যুর পর মামার বাড়িতে
মানুষ হন কালাচাঁদ।
প্রথম জীবনে মাথায় নানান
জিনিস নিয়ে ফেরি করতেন
তিনি। পরে
মশলার ব্যবসা, আরও পরে সোনার
ব্যবসা। প্রভুত
অর্থ উপার্জন করে ১১বিঘা জমি,
৯টি পুকুর সমেত অঞ্চলের
জমিদার হয়ে বসেন।
পূর্বে এখানে নীলকুঠী
ছিল। ৩২বিঘা
জমি ছিল গড় দিয়ে
ঘেরা। পরে
শরিকি ভাগের জমিতে ১৬০০বঙ্গাব্দে
বিশাল বসতবাটী ও ঠাকুরদালান গড়ে
তোলেন কালাচাঁদ।
মামার বাড়িতে বাসন্তীপূজার
চল ছিল। সেই
পূজা নিজ ভবনে নিয়ে
আসেন কালাচাঁদ দত্ত। লক্ষ্মীপুজো
দিয়ে শুরু করে চৈত্র
বাসন্তীপুজোতে শেষে হয় দত্তবাড়ির
সম্বাৎসরিক পূজার্চনা।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে
এ পুজো পেরিয়ে এসেছে
অনেক পথ। তবুও
একরকমের রয়ে গেছে খিলানওয়ালা
ঠাকুরদালান, নাটমন্দির ও পুজোর বেদি। এখনও
একই গণ্ডির মধ্যে বাস
করছেন পুরোহিত, ঢাকি। আজও
কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্পী গড়েন মূর্তি।
সরস্বতীপুজোর দিন কাঠামোপুজো হয়ে
শুরু হয় প্রতিমা গড়ার
কাজ।
সম্পূর্ণ শাক্তমতে হয় দত্তবাড়ির পুজো। ষষ্ঠীর
দিন ভাড়ার পুজো হয়,
নারায়ণকে সাক্ষী রেখে।
সপ্তমীতে কলাবউ স্নান করানো
হয় বিভিন্ন তীর্থস্থানের জল, গঙ্গার দুকুলের
জল ও যৌনকর্মীর বাড়ির
মাটি দিয়ে। অষ্টমীর
সকালে হয় চাঁচর ও
আবির খেলা। সপ্তমীর
দিন জ্বালানো হোম নবমী পর্যন্ত
জ্বলে। ধানের
মালা, চালের মালা তৈরি
করা, ১মণ চালে সন্ধিপূজা,
৪০টা নৈবেদ্য সাজানো-সবই হয়
নিয়ম মেনেই।
বাবুঘাটে গঙ্গার জল একাদশীর
কোটাল এলে তোলা হয়। তা
দিয়ে হয় পুজোর সমস্ত
কাজকর্ম। বাড়ির
সমস্ত সদস্যরা একইসঙ্গে খাওয়াদাওয়া করেন।
দত্তবাড়ির সদস্যারা পূজার পুরোনো দিনের
কথাও জানালেন আমাদের। যাত্রা
ছিল এ বাড়ির পুজোর
বিশেষ অঙ্গ। তখন
বিদ্যুৎ নয়, হ্যাজাকের আলোতে
আলোকিত হত ঠাকুরদালান ও
যাত্রামঞ্চ। নামী-দামি যাত্রার দল
আসত। গুণিজনেরা
আসতেন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করতে। বাড়ির
মেয়েদের সেসময় সর্বসমক্ষে আসার
অনুমতি ছিল না।
কাঠের চিকের আড়াল থেকে
যাত্রা দেখতেন বাড়ির মেয়েরা। ভিতরের
চোরাপথ দিয়ে ঠাকুরদালানে উঠতেন। সময়ের
সঙ্গে সঙ্গে রক্ষণশীলতা গিয়েছে,
ভেঙে পড়েছে চিকপ্রথাও।
কালাচাঁদ দত্ত শুধু পুজো
নয়, বসাতেন মেলাও জমিদারি
জুড়ে। এখন
মেলা বসে না, জাঁকজমকও সংক্ষিপ্ত হয়ে
এসেছে। তবে
নিয়মনিষ্ঠার ঘাটতি হয়নি এখনো। পারিবারিক
বকুলপুকুরে বাসন্তী প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে সমাপ্তি
ঘটে সারা বছরের পুজোপাঠের।
তথ্যসূত্র
এবং চিত্রঃ শ্রীমতী দেবযানী
বসু
No comments:
Post a Comment