আজ অনুষ্ঠিত হল
প্রাচীন শিবশক্তি অন্নপূর্ণা মন্দির ও দেবত্তর
এস্টেট এর পরিচালনায় ব্যারাকপুর
অন্নপূর্ণা মন্দিরে বিশেষ পুজো।
সেই পুজোয় বনেদীয়ানা পরিবারের
অন্যতম সদস্য শ্রীমান্ শুভদীপ
উপস্থিত ছিলেন, অন্নপূর্ণা মন্দির
সম্পর্কে তথ্য প্রদান করলেন
মথুরামোহন বিশ্বাসের পরিবারের পঞ্চমপুরুষ শ্রী অলোক কুমার
বিশ্বাস, তিনি মন্দির পরিচালন
কমিটির অন্যতম সদস্য ম্যানেজিং
সেবায়েত(প্রধান), সাহায্য করলেন মন্দিরের পুরোহিতবর্গ,
এছাড়া মন্দিরের অন্যতম সদস্য কল্যান
বাবু ইত্যাদি ব্যক্তিবর্গ। আজ
অন্নপূর্ণা পূজার পুন্যতিথিতে "বনেদীয়ানা"
য় আলোচনা ব্যারাকপুরের শ্রীশ্রীঅন্নপূর্ণা
মন্দির।
১৮৭৫ সালের ১২ই
এপ্রিল শ্রীমতী জগদম্বাদেবীর প্রতিষ্ঠিত মা অন্নপূর্ণার মন্দির,
ব্যারাকপুরের তালপুকুর রোডে।
স্নেহধন্যা জগদম্বাদেবীর ঐকান্তিক আগ্রহে পরমহংস শ্রীরামকৃষ্ণদেব
চাণকের অন্নপূর্ণা মন্দিরের প্রতিষ্ঠা দিবসেই যে উপস্থিত
ছিলেন তা নয়, তাঁরই
অনুমোদনক্রমে মথুর-জগদম্বার মনোবাঞ্ছা-মোতাবেক বিনির্মিত হয়েছে এই ঐতিহাসিক
মাতৃমন্দির। এই
মন্দিরে শ্রীরামকৃষ্ণ অবতারবরিষ্ঠ পদার্পণ করেছিলেন চারবার। প্রথমবার
জগদম্বাদেবীর মন্দির স্থাপনের বাসনায়
জমি ক্রয়কালে উপযুক্ত স্থান নির্বাচন করতে। দ্বিতীয়বার
এসেছিলেন মন্দিরের ভিতস্থাপনের দিন। তৃতীয়বার
এসেছিলেন ১৮৭৫ সালে মন্দির
প্রতিষ্ঠার দিন।
এই অন্নপূর্ণা ঠাকুরানীর
মন্দির ভবতারিণী মন্দিরের প্রতিষ্ঠার ২০বছর বাদে ১৮৭৫
সালে,১২এপ্রিল। মন্দির
প্রতিষ্ঠাত্রী জগদম্বাদেবী ছিলেন রাণী রাসমনির
কনিষ্ঠা কন্যা এবং মথুরামোহন
বিশ্বাসের পত্নী। মথুরামোহনের
ইচ্ছাকে রূপ দিতেই তিনি
মন্দির তৈরী করেছিলেন।
তারপর যুগাবতার শ্রীরামকৃষ্ণদেবের উপস্থিতিতে এই দেবালয় প্রাঙ্গনকে
কয়েক লক্ষ মুদ্রা ব্যায়ে
নির্মিত করা হয়- নবরত্ন
মন্দির, ছয় শিবের মন্দির,
নহবত, নাটমন্দির, স্নানঘাট ও দপ্তরখানার ঘর। ঠাকুর
মন্দির প্রতিষ্ঠার দিন বেলতলায় আসণ
গ্রহণ করেছিলেন, সেই বিল্ববৃক্ষ আজও
বর্তমান। অন্নপূর্ণা
মন্দিরে ঠাকুরের চতুর্থবার আগমন ঘটে ১৮৮২
সালে উল্টোরথের দিন।
রাণী রাসমনি যেমন
দক্ষিণেশ্বরের মন্দির প্রতিষ্ঠার দিন
জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে করেছিলেন ঠিক
তাঁর কন্যাও মন্দির প্রতিষ্ঠার
দিন বহু সাড়ম্বরে অনুষ্ঠান
করেছিলেন। দক্ষিণেশ্বরের
ভবতারিণী মন্দিরের আদলে তৈরী এই
ব্যারাকপুর অঞ্চলের মা অন্নপূর্ণার মন্দির। রাণী
রাসমনির প্রতিষ্ঠিত দক্ষিণেশ্বরের মা ভবতারিণীর মন্দির
এবং ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের
সাধনপীঠ।
এই
ভবতারিণীর মন্দির থেকে প্রায়
৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ব্যারাকপুর
শহর। অনেকেরই
এই বিষয়ে অজানা যে
এই ব্যারাকপুরেই রয়েছে এক নবরত্ন
মন্দির। এই
মন্দিরকে বহু মানুষ বলেন
দক্ষিণেশ্বরের 'রেপ্লিকা' আবার কেউ বলেন
দক্ষিণেশ্বরের মিনি সংস্করণ।
এই মন্দিরের দেবী মা অন্নপূর্ণা। ১৮৫৫
খ্রিঃ ৩১মে স্নানযাত্রার দিন
যেমন দক্ষিণেশ্বরের মন্দির প্রতিষ্ঠা হয়
তেমনই ১৮৭৫ সালের ১২
এপ্রিল চৈত্রসংক্রান্তির দিন প্রতিষ্ঠিত হয়
মা অন্নপূর্ণার মন্দির। ব্যারাকপুরের
আগের নাম ছিল চানক। চানক
গ্রামের এই অন্নপূর্ণা মন্দিরটি
এলাকাতে সোনার অন্নপূর্ণা নামেই
বিখ্যাত কিন্তু অন্নপূর্ণার বিগ্রহ
এখানে অষ্টধাতুর। মন্দিরে
প্রতিষ্ঠিত অন্নদাত্রী দেবী অন্নপূর্ণার বিগ্রহটি
অষ্টধাতুর শ্রীশ্রীশিবশক্তি অন্নপূর্ণা ঠাকুরানী নামে পরিচিত।
রৌপ্যশতদল আসীনা দেবীর একটি
পদ নীচে ঝোলানো, বাম
হাতে অন্নপাত্র ডান হাতে হাতা। মহাদেব
দণ্ডায়মান, অন্নপ্রত্যাশী। ছয়
শিব মন্দিরও রয়েছে এখানে, যথাক্রমে-
কল্যাণেশ্বর, কাম্বেশ্বর, কিন্নরেশ্বর, কেদারেশ্বর, কৈলাসেশ্বর এবং কপিলেশ্বর।
সারাবছর নিত্যপুজো হয় মন্দিরে।
এই দুই মন্দিরেই সেবায়েত
রাণী রাসমনির বংশোদ্ভবেরাই। মন্দিরের
প্রতিষ্ঠা দিবস আগামীকাল চৈত্রসংক্রান্তির
দিন। এছাড়া
মঙ্গলচণ্ডীর পুজো, বিপত্তারিণী পুজো,
জন্মাষ্টমী, দুর্গাপুজো, কালীপুজো, জগদ্ধাত্রী পুজো ইত্যাদি অনুষ্ঠিত
হয়।
আজ অন্নপূর্ণা পুজো
এবং নীলের পুজো একদিনে
হওয়ায় বহু ভক্তের সমাগম
হয়েছে মন্দিরে। তাদের
সাথেও কথা বলে বনেদীয়ানা
পরিবার, তাদের মধ্যে কেউ
ব্যারাকপুরেই থাকেন আবার কেউ
থাকেন কোলকাতায় বা অন্য জেলায়। বহু
ভক্ত বহু বছর ধরে
এই দিনটার জন্যই মায়ের
কাছে আসছেন তাদের একটাই
কামনা-"মা সবাইকে ভালো
রেখো এবং সবার মঙ্গল
করো"।
কথা বলেছিলাম ভোগরান্না করেন সেই বিলাসবাবুর
সাথেও, তিনি প্রায় চারবছর
ধরে মায়ের ভক্তদের জন্য
ভোগ রান্না করছেন, তারা
প্রায় ১৬জন এসেছেন এই
মহাভোজের রান্না করতে।
মায়ের ভক্তদের ভোগে ছিল- খিঁচুড়ি,
নানা রকমের তরকারি, পায়েস
ইত্যাদি। তার
কথায় প্রায় ৩০০০ ভক্তের
জন্য রান্না করছেন তিনি।
অন্নপূর্ণা
মন্দিরের প্রাঙ্গনটি টালি দিয়ে বাঁধানো,
ঘাসে মোড়া। প্রাঙ্গনের
তোরণদ্বারের ওপর স্থাপিত এক
সিংহমূর্তি। এই
সিংহমূর্তি নিয়ে ব্রিটিশের সাথে
সম্মুখ সমর হয় মন্দির
কর্তৃপক্ষের। কারণ
ব্রিটিশ দাবী করে যে
সিংহ তাদের রাজশক্তির গর্বের
প্রতীক তাই কোন নেটিভের
নির্মাণ করা মন্দিরে এই
মূর্তি থাকবে তা ব্রিটিশ
মেনে নিতে পারেনি।
ব্রিটিশ রাজশক্তিকে পরাজিত করে মন্দির
কর্তৃপক্ষ। দেশপ্রেমের
এক অনন্য নজির।
রাণী রাসমনি দক্ষিণেশ্বরের মন্দির
তৈরী করেন তাঁর স্বর্গীয়
স্বামীর মনোস্কামনা পূর্ণ করবার জন্য,
সেকথা রাণী নিজেও উল্লেখ
করেছেন। আর
ব্যারাকপুরের শ্রীশ্রীঅন্নপূর্ণা মাতাঠাকুরাণীর মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন
রাসমণিরই কনিষ্ঠা কন্যা জগদম্বা দেবী
তাঁর স্বর্গীয় স্বামী মথুরামোহন বিশ্বাসের
অভিপ্রায় পুরণের জন্য।
জগদম্বা দেবী এই মন্দিরের
জন্য দেবত্তর সম্পত্তির উল্লেখ করা ছাড়াও
নির্দেশ দিয়েছিলেন যে এই মন্দিরের পরিচালন ভার থাকবে মথুরবাবুর
পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তির হাতে। এই
দুই মন্দির স্থাপনের ক্ষেত্রেও
স্বপ্নাদেশ। রাণী
রাসমনি স্বপ্নাদেশ পেয়ে কাশীযাত্রা বন্ধ
করেন ও মা ভবতারিণীর
মন্দির তৈরী করেন।
অনুরূপভাবে জগদম্বা দেবীও নাকী নৌকা
করে গঙ্গার ওপর দিয়ে
কাশীযাত্রার সময় চানক গ্রামের
কাছে মা অন্নপূর্ণার স্বপ্নাদেশ
পান যে আর কাশী
যাওয়ার দরকার নেই এখানেই
আমায় প্রতিষ্ঠা কর।
এই ব্যারাকপুরে অন্নপূর্ণা
মন্দিরের পাশেই ছয়টি শিব
মন্দির আছে। শোনা
যায় জগদম্বা দেবীও মন্দির প্রাঙ্গনে
বারোটি শিব মন্দিরই নির্মাণ
করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু
তিনি স্বপ্নাদেশ পান যে তিনি
যেন তাঁর মায়ের অতুলনীয়
কীর্তির সাথে পাল্লা দিয়ে
মন্দির নির্মাণ না করেন।
এরপরই তিনি ছয়টি মন্দির
নির্মাণ করেন। মা
অন্নপূর্ণার মন্দির গঙ্গার পূর্বপাড়ে
অবস্থিত এবং মন্দিরের মাতৃমূর্তি
দক্ষিণমুখী। ব্যারাকপুর
মন্দিরের নির্মাণ শুরু হয় সিবি
স্টুয়ার্টের কুঠিবাড়ি কিনে। মূল
মন্দিরের সামনে নাটমন্দির অবস্থিত। অন্নপূর্ণা
মন্দিরের নাটমন্দিরের কারুকার্য অনেক বেশী।
মন্দিরের পাশে গঙ্গার ঘাট
রয়েছে, নাম রাসমণি ঘাট। এই
ঘাটে মহিলাদের সজ্জাবদলের কক্ষ আছে।
এই মন্দিরের বিস্তীর্ণ প্রাঙ্গনের রয়েছে দুইটি করে
নহবতখানা। ব্যারাকপুরের
মন্দিরের মূল প্রবেশপথ পূর্বদিকে। অন্নপূর্ণা
মন্দিরের বেলতলা মন্দিরের উঠোনের
ভিতরে।
এছাড়া অলোকবাবুর কথায়
মাকে এই দিন পোলাও,
সাদাভাত, পাঁচ রকমের ভাজা,
পাঁচ রকমের মাছ, তরকারি,
পায়েস ইত্যাদি ভোগ দেওয়া হবে। অন্নপূর্ণা
মন্দিরের বিশেষ আকর্ষণ অন্নকূট
উৎসব। প্রায়
একশো কেজি চালের অন্নকূট
হয় এই মন্দিরে।
এককথায় আজ সারাদিন
ব্যারাকপুরের শ্রীশ্রীঅন্নপূর্ণা মন্দিরে ভক্তের ভিড় দেখার
মতন, তার সাক্ষী বনেদীয়ানা
পরিবারের সদস্যরা। মা
তাঁর সন্তানদের দুহাত তুলে আশীর্বাদ
করছেন। এই
ঐতিহাসিক এবং ঐতিহ্যপূর্ণ অন্নপূর্ণা
মন্দিরের ইতিহাস এবং সারাদিন
বনেদীয়ানাকে সময় দেওয়ার জন্য
সমস্ত ভক্তকে, মন্দির কমিটির সদস্যবৃন্দদের,
রাসমণি পরিবারের সদস্যদের অনেক ধন্যবাদ।
কৃতজ্ঞতাস্বীকারঃ
শ্রী অলোক কুমার বিশ্বাস
চিত্রঋণঃ
শ্রীমান্ শুভদীপ রায় চৌধুরী,
মন্দিরের গুরুত্বপূর্ন সদস্য কল্যান বাবু
এবং শ্রী বিশ্বজিত বিশ্বাস(
রাসমণি পরিবারের সদস্য)
No comments:
Post a Comment