Tuesday, April 30, 2019

ভগিনী নিবেদিতা



সমগ্র বিশ্বে যে অখণ্ড চৈতন্যসত্তা রয়েছে, বিভিন্ন লীলাবৈচিত্র্যের মধ্যে আমরা প্রতিনিয়ত সেই প্রকাশ উপলব্ধি করি সেই প্রকাশ ভগিনী নিবেদিতার মধ্যেও লক্ষ্য করা যায় সেই প্রসঙ্গে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন-"মানুষের সত্যরূপ, চিৎরূপ যে কি, তাহা যে তাঁহাকে জানিয়াছে সে দেখিয়াছে মানুষের আন্তরিক সত্তা সর্বপ্রকার স্থূল আবরণকে একেবারে মিথ্যা করিয়া দিয়া কিরূপ অপ্রতিহত তেজে প্রকাশ পাইতে পারে তাহা দেখিতে পাওয়া পরম সৌভাগ্যের কথা ভগিনী নিবেদিতার মধ্যে মানুষের সেই অপরাহত মাহাত্ম্যকে সম্মুখে প্রত্যক্ষ করিয়া আমরা ধন্য হইয়াছি"
আজ ১৭ই বৈশাখ,১৪২৬(ইং ১লা মে,২০১৯), "মে দিবস" তাই আজ আমরা ভগিনী নিবেদিতার গৌরবময় শুভ মুহূর্তের সাক্ষী থাকব, তিনি ভারত তথা বিশ্বের কল্যাণসাধণে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের সেই মহাশক্তির অপূর্ব প্রকাশ দেখিয়ে গেলেন তাই আমরা সংক্ষিপ্ত ভাবে আজ আলোচনা করবো আলোচনায় গুরুত্বপূর্ন সদস্য শ্রীমান্ শুভদীপ রায় চৌধুরী(গবেষক)

ভগিনী নিবেদিতা এমন ভাবময়ী ছিলেন যে, অনেক সময়ব তাঁকে দেখে রক্তমাংসগঠিত দেহের অস্তিত্ব পর্যন্ত বিস্মৃত হয়ে যেত কখনও তিনি লোক শিক্ষায়িত্রী, কখনও তিনি স্নেহবিগলিতা জননী, কখনও তিনি সেবিকা আবার কখনও তিনি ভাবে বিভোরা ভগিনী নিবেদিতার জীবনকালকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে এই তিনটি পর্বের মধ্যে এক চমৎকার পরম্পরা রয়েছে প্রথমপর্ব- জন্মকাল থেকে বিবেকানন্দের সহিত সাক্ষাতের আগে পর্যন্ত দ্বিতীয় পর্ব- বিবেকানন্দের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাতের পর ভবিষ্যৎ জীবনের প্রস্তুতিপর্বই বলা যায় আর তৃতীয় পর্ব- তাঁর গৌরবোজ্জ্বল কর্মজীবনের মহত্তর প্রকাশ নীরব, অনলস কর্মের মধ্য দিয়ে প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে আত্মবিসর্জন- এই ছিল ভগিনী নিবেদিতার ব্রত
 ভগিনী নিবেদিতার পূর্ব নাম মার্গারেট এলিজাবেথ নোবেল উত্তর আয়র্ল্যান্ডের টাইরন্ প্রদেশের ডানগ্যানন নামে এক ছোট্টো শহরে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন তাঁর পিতামহ রেভারেন্ড জন নোবেল ছিলেন গীর্জার ধর্মযাজক তাঁর পুর্বপুরুষ স্কটল্যান্ড পরিত্যাগ করে আয়র্ল্যান্ডের রস্ট্রেভর শহরে বসবাস করতেন  জন নোবেল ইংল্যান্ডের শাসনের বিরুদ্ধে আয়র্ল্যান্ডের মুক্তি-সংগ্রামে সক্রিয় ভাবে যোগদানও করেছিলেন ১৮৬৭ সালে ২৮শে অক্টোবর এই ডানগ্যানন শহরে মার্গারেট জন্ম গ্রহণ করেন নিরাপদেই ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন তিনি পিতামহীর নামানুসারে শিশুর নামকরণ হয় মার্গারেট এলিজাবেথ নোবেল পরিবার একত্র হয়ে উৎসবের মধ্যদিয়ে তাঁরা নবাগত শিশুকে স্বগত জানিয়েছিলেন এইভাবে আস্তেআস্তে ভগিনী নিবেদিতার জীবনের প্রথমপর্ব শুরু হয়
 আমরা আজ তাঁর কিছু গুরুত্বপূর্ন কর্মধারার ইতিহাসই তুলে ধরবো এই পর্বে তাঁকে স্মরণ করে স্বামী বিবেকানন্দের থেকে শ্রীরামকৃষ্ণ-সংঘের ব্রত ছিল নারীজাতি নিম্নশ্রেণীর লোকের উন্নতিসাধন এই উন্নতিসাধন ছাড়া ভারতের জাতীয় জীবনের পুনরুথ্থান সম্ভব নয় 'কখনও ভুলো না, নারীজাতি নিম্নশ্রেণীর লোকদের উন্নতিসাধনই আমাদের মূলমন্ত্র'- স্বামীজীর এই বাণী নিবেদিতা শুনেছিলেন নারীজাতি এবং নিম্নশ্রেণীর মানুষের শিক্ষাদান করা , তাদের ভবিষৎ সক্রান্ত সকল প্রশ্নের মীমাংসার ভার তাদের ওপরই নারীগণ কিভাবে জীবনযাপন করবেন, বাল্যবিবাহ থাকবে কিনা, বিধবাবিবাহের প্রয়োজন আছে কিনা, অথবা যথাযথ শিক্ষালাভের পর কেউ কৌমার্যব্রত অবলম্বন করে নিজের জীবন উৎসর্গ করবে কিনা-এসকল সমস্যা সমাধানের ভার নারীগণের ওপর
 এইরূপ এক আদর্শ নারীরূপে অনন্ত করুণা প্রেমের সঙ্গে সমগ্র শক্তি দ্বারা ভারতের সেবায় জীবন উৎসর্গ করার প্রেরণা দিয়ে স্বামীজী এক সময় ভগিনী নিবেদিতাকে এক আশীর্বাণী উপহার দিয়েছিলেন-
"মায়ের হৃদয় আর বীরের দৃঢ়তা,
মলয়-সমীরে যথা স্নিগ্ধ মধুরতা,
যে পবিত্র-কান্তি, বীর্য, আর্য-বেদীতলে,
নিত্য রাজে, বাধাহীন, দীপ্ত শিখানলে;
সব তোমার হোক- আরও হোক শত
অতীত জীবনে যাহা ছিল স্বপ্নাতীত;
ভবিষ্যৎ ভারতের সন্তানের তরে
সেবিকা, বান্ধবী, মাতা তুমি একাধারে"

স্বামী বিবেকানন্দের এই আশীর্বাদ নিবেদিতার জীবনে কতটা সার্থক হয়েছিল, তা তাঁর পরবর্তী জীবনেই প্রমাণ স্বামীজী বুঝতেন যে, ভারতে স্ত্রী-শিক্ষা খুবই প্রয়োজন তাঁর জীবনের দুইটি মূল লক্ষ্য ছিল- একটি রামকৃষ্ণ-সংঘের জন্য মঠস্থাপন এবং অপরটি হল নারী শিক্ষার জন্য অন্ততঃ একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা স্বামীজী নিবেদিতাকে প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার উৎসাহই দিতেন না, তাঁকে ভারতের নারীর আদর্শ চরিত্র সম্পর্কেও ধারণা দিতেন বিদ্যালয়ের কার্যে নিবেদিতার অদম্য উৎসাহ দেখে স্বামীজী তাঁর ভবিষ্যৎ স্থায়িত্ব সম্বন্ধেও সুনিশ্চিত হয়েছিলেন নিবেদিতার প্রশংসা করে শ্রীশরচ্চন্দ্র চক্রবর্তীকে একদিন বলেছিলেন," দেখছিস্ না, নিবেদিতা ইংরেজের মেয়ে হয়েও তোদের সেবা করতে শিখেছে! আর তোরা তোদের নিজের দেশের লোকের জন্য তা করতে পারবিনি?"
 স্বামীজী বলেছিলেন একবার,'সমগ্র ভারত তার ভাবে মুখর হইয়া উঠিবে(India shall ring with her)' নিবেদিতার এই কর্মধারা এবং তিনি যেভাবে ভারত তথা বিশ্বের উন্নতির জন্য সচেষ্ট হয়েছিলেন, স্বামীজীর সেই বাণীই তার প্রমাণ কিছুকাল পরে দাক্ষিণাত্য থেকে কলকাতায়  প্রত্যাবর্তনের পর নিবেদিতার প্রথম উদ্দ্যোগ হল বিদ্যালয়ের পুনর্গঠন নিবেদিতার ইচ্ছা ছিল বিদ্যালয়ক সুপ্রতষ্ঠিত করা, তবে নিবেদিতার একার পক্ষে এই কার্যে লিপ্ত থাকা সম্ভব নয় জেনে তিনি বাইরে থেকে শিক্ষয়িত্রী নিয়োগের কথা বলেছিলেন ১৯০২ সরস্বতী পূজার পর বাগবাজার অঞ্চলের বালিকারা আবার বিদ্যালয়ে আসতে শুরু করেন ১৯০৩ সালের জানুয়ারী মাসের শেষ সপ্তাহে বক্তৃতা সফরের পর তিনি বিদ্যালয়ের দিকে দৃষ্টি দেন ১৯০৩ সালের ২৭শে জানুয়ারী থেকে তিনি নিয়মিত বিদ্যালয়ের কাজ শুরু করেন সেইসময় খুবই কম ছাত্রী বিদ্যালয়ে আসত তাদের লেখাপড়া সম্বন্ধে অভিভাবকদের কোন আগ্রহ ছিল না ভগিনী নিবেদিতা নানা ভাবে জানতে চেষ্টা করতেন যে কেন তারা আসছেন না, এমনকি তিনি নানা ভাবে চেষ্টা করতেন যে সমস্ত মেয়েরা যেন প্রতিদিন বিদ্যালয়ে আসে এইভাবে ভগিনী নিবেদিতা তাঁর জীবন মানবসেবায় সমর্পণ করেছিলেন ক্রমশ...=
 ***আজ নিবেদিতার জীবনের খুবই সংক্ষিপ্ত অংশ তুলে ধরা হল, ভবিষৎএ বনেদীয়ানা পরিবার আবারও এই প্রব্রাজিকা মুক্তিপ্রাণা নিবেদিতার জীবন নিয়ে আলোচনা করবে****
তথ্যসূত্রঃ- "ভগিনী নিবেদিতা"- সিস্টার নিবেদিতা গার্লস্ স্কুল, নবম সংস্করণ,২০১২


No comments:

Post a Comment