ঐতিহ্যের
ইতিহাসপর্বঃ
আজ বনেদীর-বনেদীয়ানা'য়
আবার এক অনন্য ইতিহাস
প্রকাশিত হল। আজকের
আলোচনায় শ্রী দুর্গার রূপান্তর-বেদ থেকে বাহ্যে,
লিখছেন গুরুত্বপূর্ন সদস্যা শ্রীমতী নন্দিনী
বসাক মহাশয়া।
শ্রী দূর্গার রূপান্তর - বেদ থেকে বাহ্যে
প্রতি
আশ্বিনের শিউলিঝরা ভোরে বেজে ওঠে
সেই অমোঘ মন্ত্রপাঠ, যা
যুগে যুগে বেদ থেকে
বাহ্যে , রূপ থেকে
অরূপে নিত্য প্রবহমান।
গানে , স্তুতিতে, চন্ডীপাঠে তারই আবাহন।
দশপ্রহরণধারিণী দেবী দুর্গা।
বাংলার আকাশে বাতাসে ধ্বনিত
হয় তারই আবাহনগীতি।
‘যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তিরূপেন
সংস্থিতা’ - তাকে শক্তিরূপে সর্বভূতে
স্থিতিলাভের জন্য প্রার্থনা করা
হয়েছে। চন্ডীপাঠের
মাধ্যমে সেই পরাশক্তিকেই আহ্বান
করা হয়। চন্ডীর
সঙ্গে আহ্বান জানানো হয়
দেবীর অন্যান্য রূপকল্পকেও, যা অর্গলাস্তোত্রের অন্তর্ভুক্ত। এই
অর্গলাস্তোত্রের ধ্বনি হলেন বিষ্ণু,
ছন্দ হলো অনুষ্টুপ ও
দেবতা শ্রী মহালক্ষ্মী ।
জগৎজননীর প্রীতির জন্য এই স্তোত্রপাঠ
করা হয় শ্রী শ্রী
চন্ডীপাঠের অঙ্গরূপে। আসুন
, একটু জেনে নিই এই
তন্ত্রোক্ত দেবী সম্পর্কে বেদাচার
কি বলছে ।
এই চন্ডীপাঠের অন্তর্গত ‘রাত্রিসুক্ত’ ও দেবীসুক্ত’ দুটি
কিন্তু ঋকবেদের ‘ শাকলসংহিতার’ অন্তর্গত ( ‘রাত্রিসুক্তে দেবীসুক্তে ঋকবেদশাকলসংহিতানায়ং প্রসিদ্ধে’)। বামনপুরাণে
ও মৎস্যপুরাণে অগ্নিসোমের ‘সোম’ই দেবী
কৌশিকী এবং ‘অগ্নি’ দেবী
কালিকা। ঋকবেদে
এই অগ্নিসোমের উল্লেখ পাওয়া যায়
। শ্রীচন্ডীতে উল্লিখিত
‘বাকসুক্ত’, ‘রাত্রিসুক্ত’ ও ‘শ্রীসুক্ত’ থেকেই
মহাকালী, মহাসরস্বতী ও মহালক্ষ্মীর আবির্ভাব
ঘটেছিল।এখানে
বেদের সঙ্গে তন্ত্রের তবে
আপাতদৃষ্টিতে কোনো বিরোধ নেই। ঋগ্বেদের
বাক্, রাত্রি ও শ্রী
- এই তিনটি সুক্ত এই
তিনদেবী রূপে রূপান্তরিত হয়ে
ভারতীয় সমাজে পূজিত হন। বেদ
থেকে তন্ত্রে, তন্ত্র থেকে পুরাণে
রূপান্তরিত হয়ে এই তিন
দেবী বিশ্বমাতৃকার স্থানলাভ করেন।
এবার আসি সপ্তমাতৃকা প্রসঙ্গে। বেদে
এই সপ্তমাতৃকার নামগুলি হল ব্রহ্মাণী, মাহেশ্বরী,
বৈষ্ণবী, ইন্দ্রানী, কৌমারী, বারাহী, নারসিংহী ও চামুণ্ডা।
তন্ত্রের অন্যতম আকর গ্ৰন্থ
আগমশাস্ত্রে এই সপ্তমাতৃকা হল
শ্রী শ্রী চন্ডী, দুর্গা
ও কালীর নামান্তর ।
এবং রূপান্তরও। আবার
এই মাতৃকাগণ দেবী কাত্যায়নীর ( দেবী
দুর্গার আদিরূপ) সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।
বৈদিক দেবী অদিতি, উষা,
সরস্বতী প্রমুখের পরবর্তীকালে তান্ত্রিকী প্রকাশ ঘটেছিল।
এমনটি মনে করা হয়
যে গুপ্তযুগে এইসব বেদোক্ত দেবীরা
তান্ত্রিক ধারায় আত্মপ্রকাশ করেছিলেন।
ডঃ হংসনারায়ণ ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘ লক্ষ্মী ও দুর্গার উৎস
হলেন বৈদিক ‘দিব্য সরস্বতী’
। পার্বতী বা
দুর্গা যে ঋকবেদের দিব্য
সরস্বতীর সঙ্গে অভিন্ন, তা
মার্কন্ডেয়পুরাণের মধুকৈটভবধ, মহিষাসুর বধ ও শুম্ভনিশুম্ভ
বধ থেকে প্রমাণিত হয়। প্রথম
অংশটির দেবী মহাকালী, দ্বিতীয়টির
দেবী মহালক্ষ্মী ও তৃতীয়টির দেবী
মহাসরস্বতী। আবার
চন্ডীর টীকাকার গোপাল চক্রবর্তী বলেছেন,
‘ সাক্ষাৎ সরস্বতী প্রাপ্তা শুম্ভাসুরনিসূদিনী ইতি যামলে’ ।
মানে হলো, রুদ্রযামল তন্ত্রে
বেদোক্ত দেবী সরস্বতীকে শুম্ভাসুরের
হন্তারক বলা হয়েছে।
ডামর তন্ত্রেও অষ্টপূজা মহাসরস্বতীর বর্ণনা আছে শুম্ভাসুরবিনাশিনী
হিসেবে।
ঈশ্বর
মূলত নিরাকার, রূপহীন । সেকারণে
প্রাচীন বৈদিক আর্যরা ঈশ্বরের
রূপ বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেছেন:
‘রূপংরূপ বিবর্জিতসৎ ভবতে ধ্যানেন যদবর্ণিতং’
অর্থাৎ হে রূপহীন ঈশ্বর,
ধ্যানে তোমার রূপ বর্ণনা
করছি। আবার
তন্ত্রমতেও দেখা যায়, মাতৃকাশক্তি
জগতের আদি কারণ।
এই নিরাকার রূপহীন ঈশ্বরকে যখন
মাতৃরূপে কল্পনা করা হয়,
তখন ভক্তের মানসিক প্রবণতার
জন্য ঈশ্বরের মাহাত্ম্য ক্ষুন্ন হয় না।
সেজন্য বৈদিক ধারায় এও
বলা হয়েছে যে ,‘ সাধকানাং
হিতার্থায়ে ব্রহ্মণে রূপকল্পনা।’ অর্থাৎ
সাধকের মঙ্গলের জন্যই ঈশ্বরের নানান
রূপ কল্পনা করা হয়েছে।
আবার সপ্তশতী শ্লোকাত্মক চণ্ডীতেও দেবী ভগবতীর বহুরূপের
কথা জানা যায়।
বিভিন্ন প্রয়োজনে দেবী নানান রূপে
প্রকাশিত হয়েছেন। কিন্তু
তত্ত্বমতে তিনি এক ও
অদ্বিতীয়া -‘একৈবাহং জগত্যত্র দ্বিতীয়া কা মমাপরা।’
নিজের ঐশ্বর্য্যবলেই তিনি বহুরূপে প্রতীয়মানা
। ‘অহং বিভূত্যা
বহুভিরিহ রূপৈর্যদাস্থিতা।’
সকাম ভক্ত এই চণ্ডীপাঠে
বহু সুখ সমৃদ্ধি ও
ভোগ লাভ করে।
আর নিষ্কাম ভক্ত চণ্ডীতত্ত্বের প্রকৃত
মর্ম উপলব্ধি করে মুক্তিলাভ করে। অর্থাৎ
এই শাস্ত্রপাঠে পাঠক ভক্তি বা
মুক্তি যা চায় তাই
পায়। ‘আরাধিতা
সৈবনৃণাং ভোগস্বর্গাপবর্গদা।’ ‘সাহযাচিতা
চ বিজ্ঞানং তুষ্টা ঋদ্ধিং প্রযচ্ছতি।’
বৈদিক
যুগেও এই আদ্যাশক্তির মহিমাই
বর্ননা হয়েছে। ঋকবেদের
দশম মণ্ডলের 125 তম সূক্তটিই দেবী
আদ্যাশক্তি ভগবতীর স্বরূপ ও
মহিমা প্রকাশক। সূক্ত
শব্দের মানে সু-উক্ত,
বিশেষ ভাবে যেটি বলা
হচ্ছে তাই সূক্ত।
বৈদিক স্তোত্রকে সূক্ত বলা হয়। এটিকে
দেবীসূক্ত বলে। এই
দেবীসূক্তেই চণ্ডীর দৈবী মাহাত্ম্য
বীজাকারে প্রচ্ছন্নভাবে ব্যক্ত হয়েছে।
একাদশ
রুদ্র, অষ্টবসু, দ্বাদশ আদিত্য, ত্রয়োদশ
বিশ্বদেবতা, দিন ও রাত্রির
দেবতা মিত্র ও বরুণ,
অশ্বিনীকুমারদ্বয় , এই সব বৈদিক
দেবতাদের রূপে মূলত আদ্যাশক্তি
পরমা প্রকৃতিই বিরাজ করেন।
তিনিই এইসব দেবতাদের আত্মার
স্বরূপ। সমস্ত
দেবতা তাঁরই অনন্ত শক্তির
প্রকাশ মাত্র। তিনিই
সর্বদেবদেবীরূপে বিরাজিতা, তিনিই জগদীশ্বরী, তাঁর
শক্তিতেই ব্রহ্মাণ্ডে সৃষ্টি-স্থিতি ও
লয় হয়। সাধকদের
তিনিই লৌকিক ও অলৌকিক,
পার্থিব ও অপার্থিব সম্পদ
দান করেন। ভোগ
ও মোক্ষ দান করেন। সকলের
অভিলাষিত যে আত্মজ্ঞান, ব্রহ্মজ্ঞান,
দেবী সেই ব্রহ্মবিদ্যা স্বরূপিণী।
দেবীসূক্তে
তিনি বলেছেন, আমি একা অদ্বিতীয়া
হয়েও বহুরূপে জগতাকারে নিজেকে বিকাশ করেছি। সেই
যে আমি তাঁকেই দেবতারা
সর্বত্র পূজা করেন।’
বিশ্বজননী আদ্যাশক্তি নিজের কথা নিজ
মুখে এখানে বলেছেন ।
তিনি বলছেন, ‘আমিই যাকে যেমন
ইচ্ছা করি তাকে তেমনি
ভাবেই সৃষ্টি করি।’
ব্রহ্মা বা ব্রহ্মজ্ঞ সব
আমার ইচ্ছাতেই হয়। রুদ্রের
শক্তিও আমি। ধর্মরক্ষার
জন্য অসুর বিনাশ করে
সাধুদের আমি রক্ষা করি।’ গীতাতে
যেমন ভগবান বলেছেন, যদা
যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি
ভারত/অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্/পরিত্রাণায় সাধুনাম বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম/ধর্মসংস্থাপনার্থায়
সম্ভবামি যুগে যুগে।’
ঠিক তেমনি আদ্যাশক্তি মহামায়াও
যুগে যুগে ধর্ম ও
ধার্মিকদের রক্ষা করার জন্য
অবতীর্ণা হন। তিনি
সর্বব্যাপী।
দ্যুলোক-ভূলোক সব কিছু
সৃষ্টি করে তাতেই অনুপ্রবিষ্ট
হয়ে আছেন। তাঁকে,
সেই ব্রহ্মময়ীকে সাধকের শুদ্ধ বুদ্ধির
সূক্ষ্ম বুদ্ধির দ্বারা প্রকাশ করা
যায়। অথবা
তিনি ঐ সূক্ষ্মবুদ্ধিসম্পন্ন সাধকের হৃদয়ে
নিজেকে প্রকাশিত করেন। শাস্ত্রে
যেমন বলা হয়েছে, ‘দৃশ্যতে
তু অগ্রয়া বুদ্ধ্যা সূক্ষ্ময়া সূক্ষ্মদর্শিভিঃ।’ এই
আদ্যাশক্তি পরমাপ্রকৃতি যদিও তত্ত্বমতে অসঙ্গা
, নির্বিকারা ও ব্রহ্মচৈতন্যস্বরূপা তবুও নিজ
শক্তিবলে তিনিই জগৎ রূপে
প্রকাশিত হয়েছেন। সেই
আদ্যাশক্তি সূক্ষ্মা, স্থূলা, ব্যক্ত ও অব্যক্ত
স্বরূপিণী। নিরাকারা
হয়েও সাকারা। তিনি
কৃপা না করলে কে
তাঁকে জানতে পারে? তন্ত্রে
তাই বলা হয়েছে, ‘ত্বমেব
সূক্ষ্মা স্থূলা ত্বং ব্যক্তাব্যক্তস্বরূপিণী/নিরাকারাহপি সাকারা কস্ত্বাং বেদিতুমর্হমি।’
এই প্রসঙ্গের সূত্র ধরেই আসি
বেদোত্তর সাহিত্য প্রসঙ্গে।
বৈদিক
সাহিত্য বাজসনেয়ীসংহিতার একটি মন্ত্রে রুদ্রদেবতার
সঙ্গীরূপে অম্বিকাদেবীর উল্লেখ পাওয়া যায়। সেখানে
তাকে রুদ্রের সঙ্গে সঙ্গিনী হওয়ার
আহ্বান জানানো হয়েছে।
এই যজ্ঞের নাম হলো
ত্র্যম্বকহোম। শতপথব্রাহ্মণেও
এই মাতৃদেবীর উল্লেখ মেলে।
আবার তৈত্তিরীয়সংহিতার মন্ত্রেও অম্বিকাদেবীর উল্লেখ রয়েছে।
এই অম্বিকাদেবীই তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণের মন্ত্রে ও শতপথব্রাহ্মণের মন্ত্রে
‘শারদী' বা শরৎকালীন দেবী
দুর্গা রূপে বর্ণিত হয়েছে। তৈত্তিরীয়
আরণ্যকে আবার অম্বিকাপতি রুদ্রের
কথা পাওয়া যায় এবং
এই রুদ্রই ঋকবেদের রুদ্রদেবতা। ( শ্লোক
৭/৫১/১২)
একইভাবে
তৈত্তিরীয় আরণ্যকে উমার কথা পাওয়া
যায়। রুদ্র
এখানে উমাপতি। কেনোপনিষদেও
উমা-হৈমবতীর ধারণা সুস্পষ্টভাবে আছে। দেবী
উমা সেখানে হিমালয় দুহিতা
পার্বতী। হিমময়
পর্বতদুহিতা বলে হৈমবতী, আবার
পর্বতবাসিনী বলে পার্বতী।
বৈদিক সাহিত্যের অনেক স্থানে শিবকে
গিরীশ ও দেবী উমাকে
গিরিজা বলেও উল্লেখ করা
হয়েছে। শ্বেতাশ্বতর
উপনিষদে শিবের উল্লেখ পাওয়া
যায় এবং সেখানে দেবীধারণার
উল্লেখে ভদ্রকালী, জ্যেষ্ঠা ও দুর্গা শব্দটির
উল্লেখও বহুক্ষেত্রে মেলে। মুন্ডক
উপনিষদে আবার কালী, করালী,
মনোভাবা নামের যেসব অগ্নিশিখার
উল্লেখ রয়েছে, এগুলি বেদোক্ত দেবতা
অগ্নির জিহ্বাস্বরূপ। কিছু
পুরাণে এই অগ্নিজিহ্বাগুলি দেবী
সরস্বতী নামে পরিচিত।
তৈত্তিরীয় আরণ্যকে কাত্যায়নী, বিরোচনী, কন্যাকুমারী প্রভৃতি নাম পরবর্তীকালে দুর্গাপ্রশস্তিতে
পাওয়া যায়।
সুতরাং
দেখা যাচ্ছে যে বৈদিক
কাল থেকে পৌরাণিক ও
পরবর্তী তান্ত্রিক যুগে ভারতে মহাশক্তির
দেবীরূপের যে ধারণা ও
উপাসনার প্রচলন হয়েছে , তার
মূল ভিত্তি কিন্তু বেদ,
তন্ত্র মূলত উপনিষদের ধারাকেই
নবরূপে উন্মোচন করেছে।
এবার চন্ডীর একটি বিখ্যাত
মন্ত্র বা সূক্ত সম্পর্কে
আমাদের বৈদিক ধারার অন্যতম
অঙ্গ যোগ কি ধারণা
দিয়েছে সে সম্বন্ধে একটু
আলোকপাত করা যাক ।
চন্ডীর
অন্যতম শ্লোক:
‘যো মাং জয়তি সংগ্ৰামে
যা মে দর্পং ব্যাপ্নোতি
যো মে প্রতিফলো লোকে
স মে ভর্ত্য ভবিষ্যতি।’
- শুম্ভনিশুম্ভকে
লক্ষ করে দেবী বলেছেন
যে, যে আমার দর্পচূর্ণ
করবে, যে জগতে আমার
তুল্য বলশালী, সেই আমার পতি
হবে।
মরমিয়া
যোগবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে যদি এই শ্লোককে
দেখা যায়, তাহলে চন্ডীর
এই আপাত রূপক শ্লোকের
আড়ালে এক অত্যন্ত গূঢ়
তত্ত্বের সন্ধান মেলে।
কি সেই তত্ত্ব? আসুন
দেখি ।
চন্ডীতে
দেবী পাঁচটি অসুরকে মধ্যে
করেছিলেন। তারা
হলেন মধু, কৈটভ, মহিষাসুর,
শুম্ভ এবং নিশুম্ভ।
যোগমতে , এই পঞ্চ অসুর
হল স্থুল তন্ত্র , ক্ষিতি,
অপঃ, তেজ, মরুৎ ও
ব্যোম। ক্ষিতি
ও অপঃ হল মধু
ও কৈটভ, তেজ হল
মহিষাসুর, মরুর নিশুম্ভ ও
ব্যোম শুম্ভ।
অসুরের
সঙ্গে দেবীর সংগ্ৰামের মাধ্যমে
মানুষের স্থুল প্রকৃতির সঙ্গে
দিব্যশক্তির সংগ্ৰামই এখানে মূল উপজীব্য। সমগ্র
চন্ডীই আসলে দিব্য জগতে
প্রবেশের জন্য সাধকের মানসিক
বৃত্তির সঙ্গে সংগ্ৰাম, কুন্ডলিনীশক্তির
জাগরণের ইতিহাস। কুন্ডলিনী
শক্তি জাগ্ৰত করার সময়
প্রবল বাধার সম্মুখীন হতে
হয় দেহের তিনটি গ্ৰন্থিতে। ব্রহ্মগ্ৰন্থি,
বিষ্ণুগ্ৰন্থি ও রুদ্রগ্ৰন্থি।
সাধকের মানসিক বৃত্তি এই
গ্ৰন্থিগুলিকে অতিক্রম করে আজ্ঞাচক্র পার
করে সহস্রারে পৌঁছালেই পরম মোক্ষলাভ হয়। মূলাধার
থেকে স্বাধিষ্ঠান অঞ্চলে থাকে ব্রহ্মগ্ৰন্থি,
সাধকের কুন্ডলিনীশক্তি এই অঞ্চলকে পার
করতে পারলেই মধু( মূলাধার)
ও কৈটভ ( স্বাধিস্থান) কে
পরাহত ও জয় করে। দ্বিতীয়
বাধা হল মণিপুর ও
অনাহত চক্রের মাঝের বিষ্ণুগ্ৰন্থিতে,
এটিই হল মহিষাসুর।
এই গ্ৰন্থিকে অতিক্রম করতে পারলেই সাধকের
অহং বা নিজের আমিত্ব
সম্পর্কে অহংকার দূর হয়। দুই
ভ্রুর মাঝখানে আছে আজ্ঞাচক্র , আর
এইখানেই শেষ বাধা রুদ্রগ্ৰন্থি
, যা শুম্ভ ও নিশুম্ভ। এই
স্তর পার করলেই প্রকৃতির
মায়া বা খেলা শেষ। সাধক
পঞ্চতত্ত্ব ও শক্তিবৃত্তের বাইরে
চলে যান ও নির্গুণ
বা গুণাতীত পুরুষে পরিণত হন,
যার গুণ হল শক্তি
। শক্তিই তখন
সাধকের অধীর হন।
অর্থাৎ সাধক দেবীকে পরাজিত
করে ( প্রকৃতি বা কুন্ডলিনীকে ) নিজের
বশে আনেন। সেজন্য
যুগে যুগে সাধকের মুখে
ধ্বনিত হয়েছে শক্তির সঙ্গে
ভক্তির এই যুদ্ধগান
- ‘আয়
মা সাধন সময়ে, দেখি
মা হারে কি পুত্রহারে।’
বৈদিক
ধারা, যেমন পুরাণ ও
দুর্গার উৎপত্তি নিয়ে যেটুকু আলোচনা
করলাম, খুব সঙ্গত ভাবেই
তা এই অল্প পরিসরে
অসম্পূর্ণ ও অগভীর।
তবে আশা রাখি , বিষয়টি
সুধীজনের আলোচনার উপজীব্য হয়ে উঠবে।
ততক্ষণ না হয় সাধক
রামপ্রসাদের আশ্রয় নিয়েই রয়ে
যাই না হয়,তারই
গানে গানে বলি ,
“ আমি
দুর্গা দুর্গা বলে মা
যদি মরি,
আখেরে,
এ দীনে না তরাও
কেমনে
জানা যাবে গো শঙ্করী”
....
তথ্যসূত্রঃ
শ্রীমতী নন্দিনী বসাক
চিত্রঋণঃ
সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবারের
আটচালার দুর্গা
No comments:
Post a Comment