ঐতিহ্যের
ইতিহাসপর্বঃ
এখন বনেদীয়ানায় অন্নপূর্ণা
পর্ব চলছে তার মধ্যে
বহু প্রাচীন এবং নবীন পুজোর
ইতিহাস লিপিবদ্ধ হয়েছে আমাদের বিভিন্ন
ব্লগ, ওয়েবপেজ ও সাইটে।
আজ আবার শ্রীমান্ শঙ্খের
লেখা "দেবী অন্নপূর্ণা এবং জগদ্গুরু শঙ্করাচার্য্য"কে নিয়ে বিশেষ
তথ্য।
দেবী অন্নপূর্ণা ও জগদ্গুরু শঙ্করাচার্য্য।
পরম অদ্বৈতবাদী জগদ্গুরু শঙ্করাচার্য্য। তিনি
যে নির্বিশেষ পরমব্রহ্ম তত্ত্বের উপরে জোর দিয়ে
অদ্বৈতবাদ মতামতের বৈজয়ন্তী প্রতিষ্ঠা করে গেছেন, তাঁর
মতবাদ হ'তে উদ্ভূত
বিবর্তবাদ তথা মায়াবাদের বিরুদ্ধে
দ্বৈতবেদান্তীদের গ্রন্থ বিশেষতঃ দ্বৈতবাদীদের
শিরোমণি বিচারমল্ল ব্যাসরাজের 'ন্যায়ামৃত' থেকে, তাঁর মিথ্যাত্ব
লক্ষণ-খণ্ডন, জগৎপ্রপঞ্চের মিথ্যাত্ব-খণ্ডন এবং বিশ্বপ্রপঞ্চের
সত্যতা-সাধন প্রভৃতি অধ্যায়
ভারতীয় আধ্যাত্বশাস্ত্রে এক একটি স্তম্ভ।
শঙ্কারাচার্য্য
প্রবর্তিত ভাবধারা বা পরম্পরার বিভিন্ন
সমালোচনামূলক রচনা তথা সভা
তথা বিতর্ক আয়োজিত হলেও
তিনি নিজের সিদ্ধান্তে অনড়। নিজের
অদ্বৈতবাদী মনোভাব এবং বৈদান্তিক
পুরশ্চরণে তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
কিন্তু
বিস্ময়ের ব্যাপার এটাই যে, এই
নিরুপার্ধিক অদ্বৈতবাদী শঙ্করাচার্য্যের লেখনিতেই পরবর্তীকালে ধরা পড়েছে, 'মহিষাসুরমর্দ্দিনী
স্তোত্র', 'দ্বাদশমঞ্জরিকা', 'গঙ্গাস্তোত্র', 'শিবাষ্টক' তথা 'অন্নপূর্ণা প্রশস্তি'
প্রভৃতি বিখ্যাত স্তবগাথা। কিন্তু
কীভাবে সম্ভব! মহীরুহের ভীতে
কি এমন আঘাত লেগেছিলো
যে, সে তার প্রকৃতিসাপেক্ষ
স্বভাবেও আমূল-পরিবর্তন আনতে
বাধ্য হলেন! কীভাবে একজন
নিরাকারবাদী পরমপুরুষ সাকারের গুণকীর্তনে মেতে উঠলেন!
জগদ্গুরু'র শিষ্য প্রশিষ্য
পরম্পরায় তাঁর যে একাধিক
জীবনীগ্রন্থ রচিত হয়েছে, তা'থেকেই এমন একটি
ঘটনার উল্লেখ করছি, যেটি
আচার্য্যবরের জীবনধারার মোড়'টাই পাল্টে
দিয়েছিলো!
"একবার
বারাণসীতে বসবাসকালে শঙ্কর অতি প্রত্যুষে
মণিকর্ণিকার ঘাটে স্নান করতে
যাচ্ছিলেন। ঘাটের
কাছাকাছি আসতেই দেখেন এক
যুবতী তাঁর মৃত স্বামীর
মাথাটি কোলে নিয়ে উচ্চৈঃস্বরে
বিলাপ করছেন এবং পথচলতি
সকলের কাছে শবদাহের জন্য
অর্থ ভিক্ষা চাইছেন।
কেউই কোনোরকম ভ্রূক্ষেপ না করে নিজেদের
পথ চলায় ব্যস্ত।
শবটি আড়াআড়ি পথ জুড়ে
এমনভাবে শোয়ানো রয়েছে যে,
যাতায়াতের কারণে অনেকেই মৃতদেহটি
ডিঙিয়ে পার হচ্ছেন।
আচার্য্য
শঙ্কর এই দৃশ্য দেখে
একতরফা থমকে দাঁড়ালেন৷ সদ্যবিধবা
সেই যুবতীকে বললেন, "মা, শবটি যদি
একটু সরিয়ে নে'ন,
তাহলে সকলেরই চলাচলের সুবিধা
হয় আর আমিও গঙ্গার
ঘাটে নামতে পারি।"
কিন্তু সেই স্ত্রীলোকটি এতটাই
আত্মহারা যে, শঙ্করের কথার
কোনো জবাব দিতে পারলেন
না৷ সমানে রোদন করে
চলেছেন তিনি। এদিকে
বিপন্ন শঙ্করও বারংবার অনুনয়-বিনয় করতে থাকলেন। অনেকক্ষণ
এভাবেই চলার পরে সহসা
স্ত্রীলোকটি তীক্ষ্ণ কণ্ঠে শঙ্করের উদ্দেশ্যে
বললেন, "আপনিই শবটি'কে
সরে যেতে বলুন না!
আপনার অনুরোধ শুনে তার
অভিরুচি হ'লে, সে
নিজেই একপাশে সরে গিয়ে
সকলের চলার পথ প্রশস্ত
করে দেবে।"
শঙ্কর
বললেন, "মা, শোকে কি
আপনার মাথা খারাপ হয়েছে?
শব নিজে কি কখনও
সরে যেতে পারে?"
- "কেন
সন্ন্যাসী! আপনিই তো সর্বত্র
বলে বেড়াচ্ছেন যে, শক্তিনিরপেক্ষ একমাত্র
ব্রহ্মেরই জগৎকর্তৃত্ব! নিষ্ফল নিরুপার্ধিক নির্গুণ
ব্রহ্ম ব্যতীত জগৎসংসারে আর
কারও আধিপত্য চলে না! কিছুই
নেই! সবই নাকি মায়া!"
সামান্যা
রমণীর মুখে এইরকম কথা
শুনে আচার্য্য স্তম্ভিত হলেন। মুুহূর্তকাল
পরেই দেখলেন, সেই রমণী আর
শব সবই অন্তর্হিত হয়েছে!
বিস্ময়বিমূঢ় শঙ্কর এই অতিলৌকিক
রহস্য বোঝার জন্য গঙ্গার
ঘাটে ধ্যানস্থ হতেই বুঝলেন, এই
অলৌকিক লীলা স্বয়ং শ্রীবিদ্যারূপিনী
অন্নপূর্ণা রচনা করেছিলেন।
তিনি অনুভব করলেন যে,
বিশ্বজুড়ে সেই আদ্যাশক্তি মহামায়ার
চিৎশক্তিই সবকিছুর মূলে। ভূলোক,
দ্যুলোক সবই তাঁরই কৃপাকটাক্ষে
স্পন্দিত হচ্ছে। তখন
অদ্বৈতবাদী শঙ্কর দরবিগলিত অশ্রু
হয়ে সেই ভবগেহিনী শ্রীবিদ্যার
স্তব করতে লাগলেনঃ
"ঈষৎ
স্বভাব কলুষা কতি নাম
সন্তি ব্রহ্মাদয়ঃ প্রতিদিনং প্রলয়াভিভূতাঃ।
এক স এব জননী
স্থিরসিদ্ধিরাস্তে যঃ পাদয়ো স্তব
সকৃৎ প্রণতিং করোতি।।"
অর্থাৎ,
সকল দেবদেবী সহ স্বয়ং ব্রহ্ম(নিরাকার পুরুষ)-এরও স্বরূপ
চিন্তা করলে কিছু না
কিছু অপূর্ণতা ধরা পড়বে, কারণ
প্রলয়কালে সকলেই অভিভূত হয়ে
পড়েন। একমাত্র
তুমি'ই নিত্যজাগ্রতা নিত্যপূর্ণা। যদি
একবারের জন্যেও কেউ তোমার
এই মহিমা স্মরণ করে
চরণকমলে প্রণত হয় এবং
শরণাগতি ভিক্ষা করে, তাহলে
তোমার কৃপাকটাক্ষে তার জাগতিক মোহমুক্তি
হয়।
সকলকে
অন্নপূর্ণা পূজার শুভেচ্ছা।
No comments:
Post a Comment