Friday, April 5, 2019

কলকাতার দুর্গাপূজার বিবর্তনপর্বঃ





  আজ এক অনন্য ইতিহাসের খোঁজ করলাম দুর্গাপুজো আজ বিশ্বসেরা তকমা পেয়েছে কিন্তু সেই দুর্গাপুজোর ইতিহাস কী?? কলকাতার দুর্গাপুজোর ইতিহাসই বা কী? কীভাবে এই পুজো এলো কলকাতায় এবং বর্তমানে কীভাবে দেবীর পূজার আয়োজন করা হয় বনেদী থেকে বারোয়ারিতে তার ইতিহাসই তুলে ধরলেন বনেদীয়ানা পরিবারের সদস্য এবং বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য প্রত্নতত্ত্ব বিভাগে গবেষণায় যুক্ত ২০১৬সাল থেকে শ্রীমান্ শুভদীপ রায় চৌধুরী
 মোঘল আমলে আমরা রাজা কংসনারায়ণের নাম পাই, দুর্গাপুজোর প্রবর্তন করেছিলেন যিনি কোন ঐতিহাসিকের মতে এই তাহিরপুর উত্তরবঙ্গের রাজশাহী জেলায় আবার কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে এটি নদীয়া জেলায় আনুমানিক সাড়ে আট লক্ষ্য টাকা খরচ হয়েছিল সই সময়
 কলকাতা শহরে আর সব কিছুর মতনই বড়িষার সাবর্ণ চৌধুরীরাই ১৬১০ সালে তাদের আটচালার মন্ডপে প্রথম স্বপরিবারে দুর্গাপূজার প্রচলন করেন এই পুজো শুরু করেছিলেন লক্ষ্মীকান্ত রায় চৌধুরী, ১৬০৮ সালে বিশাল জমিদারি পাওয়ার পর(উত্তরে হালিসহর থেকে দক্ষিণে ডায়মন্ডহারবার) এই ঐতিহাসিক আটচালা মন্ডপে ১৬৯৮ সালে ১০ই নভেম্বর জোব চার্ণকের জামাতা চালর্স আয়ারের সাথে রায় চৌধুরী বংশের কর্তাদের বৈঠক হয় এবং কলিকাতা, গোবিন্দপুর এবং সুতালুটা এই তিনগ্রামের প্রজাস্বত্ত হস্তান্তর নিয়ে ফলে কোথাও যেন দুর্গাপুজো আর কলকাতা মানসিকভাবে জুড়ে আছে



 প্রাচীন দুর্গোৎসবের মতন কুমোরটুলির গোবিন্দরাম মিত্রের পুজো আর শোভাবাজার রাজবাড়ীর নবকৃষ্ণদেবের পুজো অন্যতম রাজা নবকৃষ্ণের সাথে ইংরেজদের সদ্ভাবই ছিল তাঁর প্রভাব প্রতিপত্তির অন্যতম কারণ পলাশীর যুদ্ধে সাহায্য করার পুরস্কার হিসাবে দেন "মহারাজা" উপাধি, প্রচুর অর্থ জমি এই সাফল্যে তিনি এক দুর্গাদালান তৈরি করেন এবং সাড়ম্বরে পুজো শুরু করেন
  কলকাতার নগরায়ণের সাথে দুর্গাপুজো ওতপ্রোতভাবে জড়িত কারণ সেই সময়ে ইংরেজদের সঙ্গে ব্যবসাবানিজ্যের কারণে কিছু পরিবার বিত্তশালী হয়ে ওঠে সামাজিক প্রতিষ্ঠার অন্যতম শর্ত হিসাবে তারা রীতিমত আড়ম্বরে দুর্গাপুজোর প্রচলন করেন, কারণ সে যুগে এমন একটি সামাজিক অনুষ্ঠান আর একটিও ছিলনা দুর্গাপুজোর গোড়া থেকেই একটা আর্থ-সামাজিক উৎসবের লক্ষণ ছিল বা তাকে উপস্থাপিত করা হয়েছিল দর্জিপাড়ার মিত্রবাড়ি, দাঁ বাড়ি, চক্রবেড়িয়ার মিত্রবাড়ি, জেলেপাড়ার শ্রীমানী, ছাতুবাবু-লাটুবাবু বাড়ি, ভূকৈলাশ রাজবাড়ি, হাটখোলা দত্ত বাড়ি, জানবাজারে রাণি রাসমনির বাড়ি, বৌবাজার মতিলাল বাড়ি, দর্পনারায়ণ স্ট্রিটে খেলাৎঘোষের বাড়ি, পটলডাঙার বসুমল্লিক বাড়ি এই ধারারই ইঙ্গিত করে দুর্গাপুজোয় এইসমস্ত বনেদী পরিবারে দেবীকে বিভিন্ন উপাচারে এবং নিষ্ঠার সাথে দেবী আরাধনা হয়

 সামাজিক প্রতিষ্ঠার জন্য এই পুজো কালের নিয়মে পৃষ্ঠপোষকতার জন্য বিত্তশালীদের আঙিনা ছেড়ে বেড়িয়ে আসে জন্ম হয় "বারোয়ারি" বা "সার্বজনীন" "বারো-ইয়ারি" থেকে বারোয়ারির জন্ম গুপ্তিপাড়ার ১৭৯০ এই ধারার সূত্রপাত হলেও ১৯১০ কলকাতায় ভবানীপুর অঞ্চলে সনাতন বসু রোডের "সনাতন ধর্মোৎসোহিনী সভা" আয়োজিত পূজাই কলকাতার প্রথম বারোয়ারি পুজো একই সময় রামধন মিত্র লেনে আর সিকদার বাগানে এমন ধারার পূজা দেখতে পাই বর্তমানে ফ্ল্যাটবাড়ির পূজার রীতিতে এমন ধারার উপস্থিতি দেখা যায় এই উৎসবের জনপ্রিয় আবেদনকে কাজে লাগিয়ে ১৯২৬ সালে বিপ্লবী অতীন্দ্রনাথ বসু সিমলা ব্যায়াম সমিতির সার্বজনীন পূজা প্রচলন করে সার্বজনীন উৎসবের অর্থ- ধনী-নির্ধন, হিন্দু-অহিন্দু নির্বিশেষে সকলেই উৎসবের অংশীদার বাগবাজার সার্বজনীন, বকুলবাগানের পূজাও এরই সমকালীন

 ধর্মীয় উৎসবের প্রেক্ষাপটের আসল উদ্দেশ্য বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষকে সংঘবদ্ধ করা স্বাধীনতার উত্তরকালে এমন ধারা অব্যাহত ছিল সেই মতন বিভিন্ন পাড়ায় নানান কমিটি তৈরী হয় রাজনৈতিক আন্দোলনের বদলে সামাজিক উৎসবের মেজাজই দানা বাঁধে পরিবর্তনের পথ ধরে প্রথম বিবর্তন হয় প্রতিমায় বিভিন্ন উপাদান দিয়ে তৈরী ঠাকুর জনপ্রিয়তার শীর্ষে ওঠে শোলা, পাট, পয়সা, ধান ইত্যাদি নানান রকমের জিনিস দিয়ে প্রতিমা তৈরীর ধুম পড়ে যায় সাবেকী প্রতিমাতেও শিল্পধারার পরিবর্তন আসে সাবেকী প্রতিমায় আজও কুমোরটুলির শ্রীমতী চায়না পাল মহাশয়া, শ্রীমতী মালা পাল মহাশয়া, শ্রী সনাতন রুদ্র পাল মহাশয়, শ্রী মোহনবাঁশী রুদ্র পাল মহাশয় অন্যতম
 ৮০র শেষ দিকে প্যান্ডেলের কাঠামোর নকশায় পরিবর্তন আসে কাঠের বাটাম, কাপড় ইত্যাদি ব্যবহারে নিঁখুতকরণের ক্ষেত্রেও পরিবর্তন আসে এর পাশাপাশি কিছু পুরোনো পুজো তাদের বারোয়ারি মেজাজে ঘরোয়া আমেজ বজায় রাখতে সক্ষম হয় তাদের মধ্যে অন্যতম- উত্তরের বাগবাজার সার্বজনীন, কলেজস্কোয়ারের পুজো, দক্ষিণের বালিগঞ্জ কালচারাল, ম্যাডস্ক স্কোয়ার, উত্তরের কাশীবোস লেন, দক্ষিণের একডালিয়া সার্বজনীন অন্যতম বাগবাজার সার্বজনীন সনাতন পরিবেশকে স্বীকৃতি দেয়






  সুতরাং কলকাতার পুজো সে বনেদীই হোক কি সার্বজনীন পুজো সবক্ষেত্রেই এক অভিনবত্ব, ঐতিহ্যের ছোঁয়া লক্ষ্য করা যায় যা আজ বিশ্বের কাছে শ্রেষ্ঠতম শিরোপা পেয়েছে
**** দুর্গাপুজো কেন্দ্রিক বহু গ্রন্থের মধ্যে এই গ্রন্থ অন্যতম তাই গবেষক প্রথমেই তার রচিত গ্রন্থের কিছু অংশই তুলে ধরলেন****
কৃতজ্ঞতাস্বীকারঃ "কলকাতা দুর্গাপুজো"- অঞ্জন মিত্র(আনন্দ পাবলিশার্স)- পৃষ্ঠা নং- ৪৯ থেকে ৫৫
চিত্রঋণঃ শ্রীমান্ শুভদীপ রায় চৌধুরী



No comments:

Post a Comment