Thursday, March 28, 2019

দেবী সর্বমঙ্গলা। পূর্ব বর্ধমান।




"সর্বমঙ্গল্যমাঙ্গল্যে শিবে সর্বার্থসাধিকে
শরণ্যে ত্র্যম্বকে গৌরি নারায়ণী নমহ্স্তুতে।।"(১০)
{শ্রী শ্রী চণ্ডী, একাদশ অধ্যায়}

প্রায় তিনশো বছর আগেকার ঘটনা তখনকার বর্ধমানের সর্বমঙ্গলা "পাড়া".....! পাড়া তো দূরহস্ত লোকবসতিও ইতিউতি উঁকি দিয়ে দেখতে 'তো জঙ্গলাকীর্ণ পথঘাট... বাঁকা(দামোদরের শাখানদী)- খাল, আর দু'চারটি বাগদি-বাউড়ি সম্প্রদায়ের ঘর 'দিন এনে দিন খাওয়া' পরিবার সব খাদ্যের অভাবে মাঝেমধ্যেই বাঁকার খাল থেকে বাগদিবাড়ীর মেয়েরা গামছা পেতে, ঝুড়ি দিয়ে ছোটোমাছ, গেঁড়ি-গুগলি, শামুক ইত্যাদি ধরে যা পাওয়া যায় আরকি... না' বা মাছ পেলাম....! ধরার পরে, ঘাটেরই একটি কালো পাথরের চাঁইয়ের উপরে ঠুকে সেগুলি ভাঙে, তারপর রেঁধেবেড়ে খায় পেটের দায়ে এইভাবেই খাদ্যের সংস্থান...!
একদিন কয়েকজন চুনোলি(চুন প্রস্তুতকারক) আসে, ঘাটের ভাঙা গেঁড়ি-গুগলি, শামুকের খোলা সংগ্রহ করতে... পুড়িয়ে চুন তৈরী করবে বলে খোলাগুলোর সঙ্গে তারা ঘাটের ধারে পড়ে থাকা কালো পাথর খণ্ডটাও তুলে নিয় যায় সেটার গায়েও বহুদ্দিনের শামুকের খোলা জমে চুনের মতো আস্তরণ পড়েছে চুনোলিরা বাড়ী ফিরে পাথরের গা থেকে খোলা চেঁছে তুলতে গিয়েই দেখে যে, সেই পাথরখণ্ডটা আদতে একটা মূর্তি এতদিন উল্টিয়ে ঘাটের ধারে পড়েছিলো, তাই কেউ বুঝতে পারেনি যে সেটা আদতে কী...! কৌতুহলবশতঃ তারা সেটি নিয়ে যায় স্থানীয় ব্রাহ্মণ, পণ্ডিতপ্রবর ত্রিপুরাচরণ চক্রবর্ত্তী মহাশয়ের কাছে তিনি ভালোভাবে পরিষ্কার করে, শাস্ত্রের পাতা উল্টিয়ে আবিষ্কার করেন যে, সেটি আসলে আয়তাকার কোষ্টিপাথর খণ্ডে খোদিত একটি উগ্রচণ্ডা/মহালক্ষ্মী মূর্তি দেবী অষ্টাদশভূজা, সিংহবাহিনী মহামুণি মার্কণ্ডেয় রচিত মার্কণ্ডেয় পুরাণের পাতা থেকে দেবীর সাদৃশ্য বের করতে গিয়ে দেখলেন, মহালক্ষ্মী রূপবর্ণনার সঙ্গে মূর্তির হুবহু মিল...!

"উগ্রচণ্ডাং হৃতপদ্ম মধ্যস্থাং পীনোন্নত বক্ষরূহাং
কালাগ্নিপ্রভাং পীঙ্গলবর্ণাং নানালঙ্কার ভূষিতাম্।।
অর্ধচন্দ্র জটামুকুট নবযৌবন সমন্বিতাম্
আলিঢ়াস্যং হস্তাছিন্নং মহিষগ্রীবা ধারিণীম্।।
অষ্টাদশভূজাং মূর্দ্ধজং খেটকং ঘন্টাং দর্পণং তর্জ্জনীং
ধনুর্ধ্বজা ডম্বরূকং পাশং বামহস্তেষু বিভ্রতীম্।।
শক্তিঞ্চ মুদ্গরং শূলং বজ্রং খড়্গং তথাঙ্কুশং
শরং চক্রং শলাকাঞ্চ দক্ষিণেষু বিভ্রতীম্।।
মহিষাসুর স্কন্ধাঢ়ূর্হ জটাবদ্ধ বাম মুষ্তিকাং
অট্টাট্টহাস্য বদনাং গলদ্রূধির চর্চিতাম্।।
সব্যপাদ সরোজেনালঙ্কৃতোরু মৃগাধিপাম্
বামপদাগ্রদলিত মহিষাসুর নির্ভরাম।।......."

তিনি নিজেই রেখে দিলেন নিত্যসেবা শুরু করলেন নিজের বাড়ীতেই এদিকে এমন অলৌকিক খবর 'দিনই বা চাপা থাকে..! "গ্রামে গ্রামে বার্তা রটে গেলো ক্রমে......" অতঃ বর্ধমান মহারাজাধিরাজ কীর্তিচন্দ্র মোহতাব বাহাদুরের কানে গিয়ে কথা পৌঁছালো ধর্মপ্রাণ রাজা স্বচক্ষে দেখার উদ্দেশ্যে ঘোড়া ছুটিয়ে চললেন সেই ব্রাহ্মণের বাড়ী মূর্তি দেখেই চেয়ে বসলেন কিন্তু ব্রাহ্মণ অনড়.. তিনি তা দেবেন না অবশেষে অনেক কাকুতিমিনতির পরে রাজা কথা দিলেন যে মন্দির প্রতিষ্ঠার পরে, ত্রিপুরাচরণ এবং তাঁর বংশধরদেরই দেবীর নিত্যসেবায় যুক্ত করবেন তাতে ব্রাহ্মণ সম্মত ' রাজার হাতে দেবী আসেন কিন্তু তাঁর নামকরণ কী হবে? কোন নামপ সবাই দেবীকে চিনবে? তখন পণ্ডিতমশাই' সমাধান দিলেন বললেন, আমার গুরুবংশীয় কুলদেবী সর্বমঙ্গলা(গড়বেতা)- নামানুসারে আমি এই বিগ্রহের নামকরণ করলাম "শ্রী সর্বমঙ্গলা" অসমাপ্ত থেকে গেলো একটিই রহস্য দেবীর বিগ্রহের পাদদেশে দূর্বোদ্ধ ভাষায় কিছু লেখা আছে সেভাষার পাঠোদ্ধার সেই কীর্তিচাঁদের সময় থেকে শুরু করে আজ অব্দি কেউই করে উঠতে পারেননি সঙ্গে দেবীবিগ্রহ কত প্রাচীন, সেই তথ্যও আজও সকলের অধরা
যাইহোক, মহারাজের হাতে বিগ্রহ আসার পরেরটা তো ইতিহাস... অপূর্ব টেরাকোটার অলঙ্করণে তৈরী নবরত্ন মন্দির, পাঁচটি শিবমন্দির(শ্বেত পাথরের তৈরী দু'টি শিবলিঙ্গঃ বাণেশ্বর রামেশ্বর এবং কোষ্টিপাথরের তৈরী তিনটি শিবলিঙ্গঃ চন্দ্রেশ্বর, মিত্রেশ্বর ইন্দ্রেশ্বর), নাটমন্দির, ভোগঘর, অতিথিশালা, নহবতখানা, বাগান, পুকুর, কামান...... সব মিলিয়ে কয়েকবিঘা জায়গা জুড়ে তৈরী হলো আজকের সর্বমঙ্গলা মাতার দেবীদেউল প্রতিষ্ঠাকালঃ ১৭০২ খ্রীস্টাব্দ পরবর্তীতে মন্দির চত্তরে আরও কেয়কটি ছোটো মন্দির স্থাপিত হয় সে' ১৮০০ সালের পরের দিকের ঘটনা মনে করা হয়, বঙ্গীয় "রত্নঘরানা" গঠনশৈলীর আদি-নিদর্শন গুলির মধ্যে অন্যতম এই সর্বমঙ্গলা মন্দির বর্ধমান রাজবংশীয় শেষ মহারাজ উদয়চন্দ্র মোহতাব বাহাদুর, দেবীর নিত্যসেবা বার্ষিক মহোৎসবগুলির ধারাবাহিকতা অব্যহত রাখার উদ্দেশ্যে, "শ্রী শ্রী সর্বমঙ্গলা মাতা দেবোত্তর ট্রাস্ট" গঠন করে দিয়ে যান
এখানে, সারাবছরই মহোৎসবের আমেজ লেগে থাকে ভোর হতে না হতেই নহবতখানায় সানাই বাজে(রেকর্ডিং ক্যাসেট) বেলা বাড়ার সাথে সাথে দর্শনার্থীদেরও ভীর বাড়তে থাকে মন্দিরের গর্ভগৃহের দরজা খোলা হয় সকাল ৬টা নাগাদ তার আগে, দেবীর মঙ্গলারতি হয়ে, স্নান করিয়ে, নতুন কাপড়-গহনায় সাজিয়ে সিংহাসনে বসানো হয়
সকালে দেবীকে পূর্বাহ্নের পূজোয় রোজই ফলমূল, মিষ্টি, খোয়া, লুচি ইত্যাদি নিবেদন করা হয় দুপুরের ভোগে পঞ্চব্যঞ্জনসহ অন্নভোগ নিবেদন হয় মাছের পদ রোজই থাকে কখনও বা ছাগমাংসও নিবেদন করা হয় দেবীর দ্বিপ্রাহরিক ভোগ, আরতি নিবেদনের পরেই ভোগ বিতরণ শুরু হয় তখন গর্ভগৃহের দরজা বন্ধ থাকে আবার খোলা হয় বিকাল ৪টে নাগাদ খোলা থাকে রাত্রি ৮টা অব্দি এরমাঝে, বিকালে বিভিন্ন রকমের ফল, ডাবের জল/বেলের সরবৎ, কাঁচাপাকের সন্দেশ ইত্যাদি এবং রাত্রিতে লুচি, ভাজাভুজি, তরকারি, মিষ্টি নিবেদন করা হয় অতঃ শয়নারতি সেড়ে মন্দিরের কপাটে খিল দেওয়া হয় এই হলো এখানকার রোজনামচা
এছাড়া বড় অনুষ্ঠান বলতে পয়লা বৈশাখ, অক্ষয় তৃতীয়া শারদীয়া দুর্গোৎসব তখন হাজার হাজার ভক্ত সমাগম হয় বাঁশের ব্যারিকেড করে আলাদা লাইন করা হয় প্রচুর পূজো পড়ে আগত সকলকে দেবীর প্রসাদ ভোগ বসিয়ে খাওয়ানো হয় শারদোৎসবে সপ্তমীর সকালে বিরাট শোভাযাত্রা সহকারে দেবীর নবপত্রিকা স্নান ঘটোত্তলন হয় স্থানীয় দীঘি থেকে মহাষ্টমী মহানবমী তিথি দু'টিতে ছাগ, মেষ উৎসর্গ হয় আগে মহিষ বলিদানের প্রথাও ছিলো, এখন তা বন্ধ হয়ে গেছে কয়েকবছর আগেও মহাষ্টমীতে সন্ধিপূজোর সূচনা 'তো কামান দাগিয়ে কিন্তু, ১৯৯৭ সালের ৯ই অক্টোবর, রাত্রি ১১টা নাগাদ সন্ধিপূজোর সূচনালগ্নে কামান দাগানোর সময়ে এক দুর্ঘটনায় সারা বর্ধমান কেঁপে ওঠে কামানটি সশব্দে ফেটে যায় আসেপাশে ভীর করে থাকা জনতার প্রায় শতাধিক মারাত্মকভাবে আহত ' যিনি কামান দাগাচ্ছিলেন, মন্দিরের তৎকালীন প্রধান পুরোহিত পণ্ডিত অনাথনাথ আচার্য্য ঘটনাস্থলেই মারা যান, মন্দিরও ক্ষতিগ্রস্ত হয় এই দুর্ঘটনার পর থেকে, কামান দাগানোর নিয়ম বন্ধ হয়ে গেছে, পরিবর্তে বন্দুকের আওয়াজ দিয়ে সন্ধিপূজো শুরু হয়
বছরের বিশেষ কয়েকটি অমাবস্যা(ফলহারিণী, কৌষি, দীপান্বিতা, বকুল, রটন্তী)- দেবীর বিশেষ পূজো হয়ে থাকে ছোটোখাটো, মাঝারি অনেক অনুষ্ঠান, বিবাহ, উপনয়ন সংস্করণ, অন্নপ্রাশনের পাশাপাশি জয়মঙ্গলবার, বিপত্তারিণী, শিবরাত্রি, রথযাত্রা, অবাঙালীদের 'কর্বা-চৌথ্', নবরাত্রি  ইত্যাদি উপলক্ষ্যে মন্দির চত্তরে বহু ভক্তসমাগম হয় বর্ধমান সদরে এখনও একটি রীতি এই সর্বমঙ্গলা মাতাকে কেন্দ্র করে রয়েছে যে কারুর বাড়ীর কোনো অনুষ্ঠানে "কার্ড ছাপানো"- পরে প্রথম কার্ডটি দেবী সর্বমঙ্গলাকে উৎসর্গ করা হয় বছরের বিশেষ কয়েকটি দিনে দেবীর সারাবছর ধরে পূজোয় আসা প্রণামী বস্ত্র দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করা হয় আবার অনেকের কাছে বস্ত্র নিলামে তুলে বিক্রিও করা হয় সেই বিক্রির টাকা দেবীর ট্রাস্টে চলে যায় কাশীতে শ্রী অন্নপূর্ণা মাতার মতো বর্ধমানেও দেবী সর্বমঙ্গলা সদা জাগ্রতা দেবীর দুয়ার থেকে আজ অব্দি কোনো সন্তানকে অভুক্ত অবস্থায় ফিরে যেতে হয়নি
সবশেষে বলি, অনেকেই বলে থাকেন যে বর্ধমানের সর্বমঙ্গলা মন্দির একটি "সতীপীঠ" ধারণা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত আদতে সর্বমঙ্গলা মন্দির একটি "শক্তিপীঠ" তন্ত্রের দেশ- বঙ্গদেশের অন্যতম বিখ্যাত মাতৃসাধক কমলাকান্ত ভট্টাচার্য্য একসময়ে বর্ধমান রাজপরিবারের কুলগুরু তথা সর্বমঙ্গলাদেবীর নিত্য সেবক ছিলেন পরবর্তীতে তাঁরই সাধনার সুবিধার্থে নির্জন স্থানে আলাদা কুটির করে তিনি সড়ে যান সেখানেই ইষ্টদেবী কালিকার সাধনায় সিদ্ধিলাভ করে শ্রী শ্রী সিদ্ধেশ্বরী'কে প্রতিষ্ঠা করেন সেই সাধনক্ষেত্র আজ কমলাকান্ত কালীবাড়ী নামে পরিচিত পরের পর্বে এই শক্তিপীঠ প্রসঙ্গে জানানোর চেষ্টা করবো
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ
স্বর্গীয় উদয়শংকর চক্রবর্ত্তী
(দেবীর প্রধান পুরোহিত)
(কার্য্যকালঃ ১৯৯৮ - ২০০৯)
তথ্যসূত্র এবং চিত্রেঃ শ্রীমান্ শঙ্খ




No comments:

Post a Comment