Friday, March 29, 2019

ঐতিহ্যের ইতিহাসপর্বঃ৩৭(বিষ্ণুপুরের মৃন্ময়ী)




বনেদীর-বনেদীয়ানা" শুধুমাত্র পুজো নয় বহু প্রাচীন মন্দির, স্থাপত্য, প্রাচীন ঐতিহ্যের খোঁজ করে। তাই আজ আবারও ইতিহাস গবেষণায় শ্রীমান্ শঙ্খ। আলোচনার বিষয়- বিষ্ণুপুরের মৃন্ময়ী।
দেবী মৃন্ময়ী বিষ্ণুপুর

জয়পুরের রাজপুত মহারাজা নৃসিংহ দেব সপরিবারে চলেছেন শ্রীক্ষেত্রে, তীর্থভ্রমণের মানসে সঙ্গে রয়েছেন সন্তানসম্ভবা স্ত্রী মহারাণী রত্নাবলী দেবী মহারাজের ইচ্ছা, শ্রীক্ষেত্রেই যেন রাণীমা, সন্তানের জন্ম দেন এর আগে বেশ কয়েকটি সন্তান জন্মের পরে বেশীদিন বাঁচেনি তাই রাজা মানসিক করেছেন জগতের নাথ জগন্নাথের কাছে, যদি সন্তান দীর্ঘজীবী হয়, তবে শ্রীক্ষেত্রকে সোনায় মুড়ে দেবেন তিনি আরও একটি বাসনা যে, জগন্নাথধামেই যেন সন্তান ভূমিষ্ঠ হয় যেমন ভাবা, তেমন কাজ..!
রাজ শিবিকা-রথের আগে পরে অগণিত সৈন্যসামন্ত, লোকলস্কর, দাসদাসী হাজার হোক রাণীমা রয়েছেন, তাঁর বিশেষ যত্নের প্রয়োজন এখন পথে কোনোরকম অসুবিধায় না পড়তে হয়, তাই রাজার এই বিপুল আয়োজন যাইহোক, বেশ অনেকটা পথ এগিয়ে এসেছেন প্রায় চন্দনেশ্বরের কাছাকাছি আসতেই রাণীমা' অবস্থা ক্রমে অবনতির দিকে...! যাত্রার ধকল তিনি আর সইতে পারছেন না মহারাজ আর বেশীদূর এগোতে সাহস পেলেন না৷ অগত্যা, স্থানীয় এক ব্রাহ্মণ হরিহর মিশ্রের বাড়ীতেই কয়েকজন দাসী সমেত রাণীমা কে রেখে এগিয়ে গেলেন শ্রীক্ষেত্রের পথে যাবার আগে, রাণীর পাহারায় এক বিশ্বস্ত সৈন্যকেও রেখে গেলেন যাতে সন্তান জন্মের খবর সময়মতোই মহারাজ পা' রাণী'কেও আস্বস্ত করে গেলেন, জগন্নাথের প্রসাদ নিয়েই তিনি ফিরবেন
কয়েকদিনের যথাযথ পরিচর্যায় রাণীমা বেশ সুস্থ হয়ে উঠলেন এবং সময়কাল আগত 'লে একটি সর্ব-সুলক্ষণ পুত্রসন্তানের জন্ম দিলেন দিনটা ছিলো বৃহস্পতিবার, বঙ্গীয় পঞ্জিকায় ৮৫ সন ১৯এ চৈত্র, রামনবনী তিথি ইংরাজীর ৬৭৭ খ্রীস্টাব্দ, ২রা এপ্রিল আশ্রয়দাতা ব্রাহ্মণ শিশুটিকে একপলক দেখেই চমকে ওঠেন 'যে অসম্ভব...! এমন শিশু মানুষের গর্ভে কীভাবে জন্মায়...! যে দেবশিশু..! কপালে স্পষ্ট অর্ধচন্দ্র চিহ্ন, হাত-পায়ের তালুর রেখা শুদ্ধ স্পষ্ট..!
ওদিকে প্রহরী সৈন্যটি ঘোড়া ছুটিয়ে চলেছে, শ্রীক্ষেত্রের দিকে রাজামশাই'কে খবর দিতে হবে কিন্তু, বিধি যে বাম...! শ্রীক্ষেত্র পৌঁছানোর আগেই দেখা বাকী লোকলস্করের সাথে সকলেই সেদিকে আসছেন কী ব্যাপার? মহারাজের তো এখন আসার কথা নয় তবে কি তিনি আগেই খবর পেয়েছেন? কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করতেই, সবার মুখ থমথমে কী হয়েছে? মহারাজ কই? আজ আনন্দের দিন, রাণীমা পুত্রের জন্ম দিয়েছেন, সবাই আনন্দ করো মনমরা হয়ে আছো কেন??
সবশেষে, মৌন ভঙ্গ করে সেনাপতি অকালে বজ্রপাতের মতোই বললেন, মহারাজ গতদিন বিকালে নরেন্দ্রসরোবরে সর্পাঘাতে মারা গেছেন..!
এরপরের ঘটনা প্রায় সকলেরই বোধগম্য খবর রাণীমার কানে পৌঁছাতেই মূর্চ্ছা যান আর তাঁর জ্ঞান ফেরেনি ওদিকে মহারাজের মৃত্যুর খবর তীরের বেগে রাজধানীতে পৌঁছায় সুযোগসন্ধানী মন্ত্রিমশাই সিংহাসনের সদ্ব্যবহারে ব্যস্ত হয়ে পরেন তীর্থ ফিরত সৈন্যরা, সদ্যোজাত রাজপুত্র'কে কালসর্প জ্ঞানে সেই ব্রাহ্মণের কাছেই ছেড়ে যায়
ব্রাহ্মণের পরিচর্যায় আস্তে আস্তে বড় হতে থাকে সে রামনবমীতে জন্ম, তাই তার নামকরণ করা 'লো রঘুনাথ আশ্রিত যে উচ্চবংশীয় ক্ষত্রিয়সন্তান, সেটা ব্রাহ্মণ জানতেন, তাই অল্পবয়সেই 'মল্ল যুদ্ধ' পাঠের আখড়ায় ভর্তি করলেন সঙ্গে চলতে থাকলো, বিভিন্ন শাস্ত্রের নিয়মিত পাঠ
খুব অল্প বয়সেই রঘুনাথ শস্ত্র এবং শাস্ত্রের নিয়মিত চর্চায় অসামান্য ধীশক্তি পাণ্ডিত্য অর্জন করেন
হঠাৎই একদিন শোনা গেলো, রাজ্যের মহারাজ বৃদ্ধ হয়েছেন, কিন্তু তিনি নিঃসন্তান তাই সর্বশাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিতদের আহ্বান জানিয়েছেন রাজধানী প্রদ্যুম্নপুরে(বর্তমান বাঁকুড়াপুরুলিয়া জেলার সীমানা) দত্তকসন্তান সংক্রান্ত শলাপরামর্শের জন্য পণ্ডিত হরিহর' তরুণ রঘুনাথকে নিয়ে উপস্থিত হলেন রাজদরবারে আলোচনা সভায় সকলের পরামর্শ বক্তব্য রাখার মাঝেই মহারাজের নজর পড়লো, রঘুনাথের উপরে অল্পবয়স্ক এই তরুণের ধীশক্তি, গাম্ভীর্য্য বিচক্ষণতা রাজাকে বারবার মুগ্ধ করতে থাকে অবশেষে, আলোচনা সভা অসময়ে স্থগিত রেখেই মহারাজ, পণ্ডিত হরিহরের কাছে রঘুনাথকেই চেয়ে বসেন
ব্রাহ্মণও মনে মনে এটাই চেয়েছিলেন তা' হলো রঘুনাথকেই দত্তক নিলেন মহারাজ প্রকাশ্যে অভিষেক করলেন যুবরাজকে
সেটা ৬৯৪ খ্রীস্টাব্দ, বাঙলার ১০২ সন যুবরাজ রঘুনাথের তখন ১৭ বছর বয়স
পরেরবছরই যুবরাজ রঘুনাথকে রাজ্যাভিষেক করে মহারাজ ঘোষণা করা 'লো এরপরেই নিজস্ব শস্ত্রশিক্ষা মল্লযুদ্ধের কৌশল প্রয়োগ করে মহারাজ এক বিশাল সেনাবাহিনী গঠন করেন এবং পার্শ্ববর্তী কলিঙ্গ, প্রাগ-জ্যোতিষ, বরেন্দ্র, নালন্দা, রাজগীর হয়ে সুদূর কণৌজ পর্যন্ত নিজের রাজত্বের সীমানা সুরক্ষিত করলেন মাত্র পাঁচবছরের মধ্যে এরপরেই নিজে "আদি মল্ল" উপাধি গ্রহণ করেন এবং রাজধানীর নামকরণ করলেন "মল্লভূম" কালের নিজস্ব গতিতে সবকিছুই নিয়মমাফিক চলতে লাগলো জয়মল্ল, বেণুমল্ল, যাদবমল্ল, জগন্নাথমল্ল, বিরাটমল্ল প্রমুখ মহারাজের সময়কাল পেড়িয়ে এবারে আসা যাক, মহারাজ রঘুনাথ তথা আদিমল্লের ঊনবিংশতম উত্তরসূরী মহারাজ জগৎমল্ল(৯৯৪ খ্রীস্টাব্দ-১০০৭ খ্রীস্টাব্দ)-এর আমলে সিংহাসনে বসার দিন থেকেই মহারাজ জগৎমল্ল শাসক হিসাবে প্রজাদের মনে নিজের একটি আলাদা স্থান করে নিয়েছিলেন রাজবংশের ইতিহাস বলে, জগৎমল্লের আমলই মল্লবংশের সুবর্ণযুগ রাজ্যের বিস্তার, সুশাসন ব্যবস্থা, বিভিন্ন স্থাপত্যকর্ম তথা রাজধানীর নিত্য জলকষ্ট দূরীকরণে জলাধার নির্মাণ ইত্যাদি প্রায় সবই জগৎমল্লের কীর্তি মহারাজ নিজেও মাঝেমধ্যেই ছদ্মবেশে বেড়িয়ে পড়তেন রাজ্যপ্রদর্শনে এইরকমই একবার রাজ্যপরিচালনায় সুষ্ঠু নিয়মানুবর্তীতা কোথায় কীভাবে পালিত হচ্ছে, না হচ্ছে সেসব চাক্ষুষ করতে মহারাজ কয়েকজন বিশ্বস্ত লোকজন নিয়ে বেড়িয়ে পড়েন পথমধ্যে সন্ধ্যা হওয়ায়, দামোদরের দক্ষিণকূলে বনবিষ্ণুপুর জঙ্গলেই থামার সিদ্ধান্ত নে' কর্মচারীরা শিবির তৈরী করতে ব্যস্ত ওদিকে রাজামশাই, জঙ্গলের গভীরে গেছেন, পশু শিকারের মানসে দূর থেকে একটি হরিণ দেখতে পেয়েই ধনুকের জ্যা'তে সজোড়ে তীর মারলেন তীরবিদ্ধ হরিণ ছুটে যেতেই রাজাও তার পিছু নিলেন কিছুটা গিয়ে দেখলেন, হরিণটি একটা বটগাছের নীচে ছটফটিয়ে গড়াগড়ি দিচ্ছে এবং আচমকাই সেই বেলগাছ থেকেই এক নারীমূর্তির উদয় হয় তিনি তীরবিদ্ধ হরিণের তীর বের করে ক্ষতস্থানে হাত বোলাতেই হরিণ উঠে দাঁড়ায়, আনুগত্যবশতঃ তাঁর পা চাটতে থাকে....! এই অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখে রাজামশাইয়ের বাকশক্তি রহিত হবার জোগাড় কিছু পরে, সম্বিত ফিরে পেয়েই ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরলেন সেই নারী পা দু'টি বলো তুমি কে? বহু সাধাসাধির পরে অগত্যা, জ্ঞানত মাতৃহীন সন্তানের উপর কৃপা করলেন কৃপাময়ী দশভূজা কাত্যায়ণী স্বরূপ দেখালেন অবোধ সন্তানকে মাতৃদর্শনের আনন্দে আত্মহারা মহারাজ জগৎমল্ল চোখের জলে ভাসছেন... আনন্দে ধূলোয় গড়াগড়ি দিচ্ছেন... দেবীর পা জড়িয়ে মিনতি করে চলেছেন, আর তোমায় ছাড়ছি না মা আমার কাছেই তোমাকে থাকতে হবে দেবী স্মিতহাস্য মুখে সম্মতি দিলে, মহারাজ তৎক্ষনাৎ মনস্থির করেন, রাজধানী স্থানান্তরিত করবেন করলেনও প্রদ্যুম্নপুর থেকে রাজধানী স্থানান্তরিত হয়ে এলো, বনবিষ্ণুপুরে জঙ্গল পরিষ্কার করে বসতি স্থাপন 'লো শুধু কাটা 'লোনা সেই বটগাছটি যার নীচে রাজার দেবীদর্শন হয়েছিলো
রাজত্বের বাছাই করা মৃৎশিল্পী এনে, গঙ্গামাটি দিয়ে তৈরী করানো হলো, রাজার সম্মুখে প্রকট হওয়া চিন্ময়ী মায়ের মৃন্ময়ী বিগ্রহ সেই বটগাছের সামনেই তৈরী হলো মন্দির শোনা যায়, প্রথম মন্দিরটি মাটির তৈরী ছিলো কীভাবে দশভূজার আরাধনা 'বে, সেই বিধান জিজ্ঞেস করায় রাজপুরোহিত বৃহন্নন্দীকেশ্বর পুরাণ কালিকা পুরাণে উল্লিখিত দুর্গোৎসবের নিয়ম নির্ধারণ করে দিলেন শুরু 'লো, #বঙ্গদেশের_প্রথম_আনুষ্ঠানিক_শারদোৎসব সালটা ৯৯৭ খ্রীস্টাব্দ রাজার ইচ্ছ ছিলো, তাড়াহুড়ায় দেবীর মাটির মূর্তি মাটির মন্দির করালেও, শারদোৎসবের পরেই পাকা মন্দির বিগ্রহ তৈরী করাবেন মন্দির পাকা নির্মাণ করালেও, দেবীর বিগ্রহ পাল্টানোর সময়েই রাজা বাধা পেলেন মনে খটকা লাগলো যে মূর্তিতে একবার মায়ের প্রাণপ্রতিষ্ঠা করিয়ে অধিষ্ঠান করিয়েছি, সেই মূর্তি পাল্টাতে গেলে তো, মা'কে বিসর্জ্জন দিতে হবে..! তা কী করে হয়, এদিকে মাটির মূর্তি.. যদি বেশীদিন না থাকে..! অঙ্গহাণী হয় যদি..! তখনও চিন্তিত রাজার মানসপটে ভেসে ওঠে দেবীর প্রতিকৃতি আদেশ দেন, যেমন আছে তেমনই থাক মূর্তি নিয়ে অত চিন্তা করিস না যতদিন আমার প্রত্যক্ষ উপস্থিতি এখানে থাকবে, ততদিন মূর্তিও অবিকৃত অবস্থায় থাকবে
সেই শুরু তারপরে দামোদর দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে অনেক ঝড়ঝাপটা অতিক্রম করে, প্রায় তেরশো(,৩০০) বছরেরও বেশী সময়(৬৯৪ খ্রীস্টাব্দ থেকে ১৯৮৩ খ্রীস্টাব্দ) ধরে রাজমর্যাদায়(রাজত্ব শাসন চলে যাবার পরেও) অধিষ্ঠিত, ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরখচিত বঙ্গদেশের অন্যতম শাসকবংশ, "বিষ্ণুপুর মল্লরাজবংশ" আর মল্লরাজবংশের একহাজার বাইশ(১০২২) বছরের প্রাচীন কুলদেবী "মা মৃন্ময়ী"
দেবী মৃন্ময়ীর প্রসঙ্গে আসা যাক দেবীর আদি মন্দিরটি কেমন ছিলো, তার কোনো প্রমাণ বা চিহ্ন আজ পাওয়া যায়না বর্তমানে যে মন্দিরে দেবীর বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিতা, সেটি মল্লবংশের ৫৯তম উত্তরসূরী মহারাজ রামকৃষ্ণদেব(১৮৭৬ খ্রীস্টাব্দ- ১৮৮৫ খ্রীস্টাব্দ) নির্মাণ করান মন্দিরটি বঙ্গীয় স্থাপত্যরীতির "দালান" শৈলীতে গঠিত পাঁচখিলনের দালানে বিরাজিতা জগন্মাতার গর্ভগৃহের সামনাসামনিই রয়েছে সেই স্মৃতিবিজড়িত বেলগাছ সেখানে আজও শারদোৎসবের ষষ্ঠ্যাদি বোধন অধিবাস হয়ে থাকে মন্দিরের এলাকাটি বিরাট... বিরাট বড়ো অথচ, শান্ত.. মৌন.. সমাধিমগ্ন যোগীর মতো নিষ্কম্প দীপশিখা.... সুদূর ইতিহাসের অজস্র অসংখ্য ঘটনা, প্রেক্ষাপটের নীরব সাক্ষী পাশেই একটি দীঘি আছে সেখানকার জলেই দেবীর নিত্যসেবা ভোগ ইত্যাদি হয় মন্দিরের উত্তরদিকে(পিছনে) একটি ভাঙা পোড়োপ্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে ঐতিহাসিকরা বলেন, ঐটিই জগৎমল্ল প্রতিষ্ঠিত রাজবাড়ী মন্দিরের গর্ভগৃহের একটু আগেই একটি কামান আছে তাতে আগে তোপদাগা 'তো, পাশাপাশি অঞ্চলে পূজোর শুভসূচনা প্রচারের উদ্দেশ্যে
মৃন্ময়ী দেবী এখানে সপরিবারে অধিষ্ঠিতা তবে পরিবার সজ্জার ধরণটি আলাদা সচরাচর, মহাদেবীর দু'পাশে লক্ষ্মী সরস্বতী থাকেন তাঁদের নীচে অধিষ্ঠান করেন গণেশ কার্ত্তিক এখানে দেবীর দু'পাশে গণেশ কার্ত্তিক রয়েছেন লক্ষ্মী সরস্বতী রয়েছেন নীচে চালচিত্রের শিখরে নন্দীভৃঙ্গী সেবিত দেবাদিদেব রয়েছেন সম্পূর্ণ বিগ্রহটি মাটির তৈরী বছর বছর অঙ্গরাগ করা হয় এটা কি সত্যিই দৈবমহিমা নাকি ব্যতিক্রমী সূত্র যে, একটানা হাজার বছরেরও বেশী সময় ধরে একটি মাটির বিগ্রহ অবিকৃত অবস্থায় পূজো গ্রহণ করে আসছেন...!! সারাবছরই কমবেশী ভক্তসমাগম হয় তবে সেটি অনিয়মিত, কখনও কম কখনও বেশী তবে, শারদোৎসবের ব্যপারটা সম্পূর্ণ আলাদা
এখানে পূজো শুরু হয়, শারদীয়া শুক্লা ষষ্ঠীর পনেরো(১৫)দিন আগে অর্থাৎ, কৃষ্ণপক্ষীয় প্রতিপদ তিথিতে সেদিন, স্থানীয় পটচিত্র শিল্পীদের তৈরী দেবী পটেশ্বরী(বড় ঠাকুরাণী) মৃন্ময়ী মন্দিরে আসেন শুরু হয়, নিত্য ষোড়শোপচারে আরাধনা সঙ্গে যজ্ঞাগ্নি প্রজ্জ্বলিত হয়ে উঠতো একটানা পালা করে পুরোহিতরা যজ্ঞে আহুতি দিতে থাকতেন, সঙ্গে চণ্ডীপাঠ শুক্লা ষষ্ঠীতে আসেন দ্বিতীয় পটেশ্বরী(মেজো ঠাকুরাণী) মেজোঠাকুরাণীকে বটগাছের নীচেই প্রথমে স্থাপন করা হয়, প্রতীকি বিল্বশাখা রোপন করে বোধন অধিবাসের পরে মৃন্ময়ীর পাশে বসানো হয় সপ্তমীর দিন সকালে আসেন তৃতীয় পটেশ্বরী(ছোটো ঠাকুরাণী) সঙ্গে তিনজন পটেশ্বরী ঠাকুরাণীর তিনটি পৃথক নবপত্রিকা মহাষ্টমী তিথির সন্ধিলগ্নে(শেষ ২৪মিনিটের সূচনাকালে) একটি পিতলের গামলায় জল ভর্তি করে তাতে অতিসূক্ষ্ণ ছিদ্রবিশিষ্ট একটি বাটি ভাসিয়ে দেওয়া হয় ছিদ্রযুক্ত বাটি'টি নাকি এমনভাবেই তৈরী যে জল ভর্তি হয়ে গামলায় ডুবে যেতে তার ২৪মিনিট সময় লাগে; অর্থাৎ, সন্ধিক্ষণেই সেটি ডুবে যায় ডোবার সাথে সাথেই বলিদান শুরু হয় মহাষ্টমীর মধ্যরাত্রে এখানে 'অর্ধরাত্র বিহিত পূজা'- নিয়ম আছে
এই পূজোতেই কোনো এক সময়ে নাকি বিরোধী পক্ষীয় রাজা/তষ্কর/রাজবিরোধী/বিশ্বাসঘাতকদের ধরে আনা 'তো এখানে তাকে/তাদেরকে বলিদান দেওয়া 'তো এখনও মন্দিরের গর্ভে একটি প্রাচীন কীটদষ্ট ক্ষয়ে যাওয়া যূপকাষ্ঠ রয়েছে, সেই নরবলির জলজ্যান্ত নীরব প্রতিনিধিত্ব পালন করে চলেছে যেন...! এছাড়াও মহানবমীতে মহিষ সহ মেষ ছাগ বলিদানের নিময়ও ছিলো এখানে প্রতিপদের দিন প্রজ্জ্বলিত হওয়া যজ্ঞাগ্নিতে পূর্ণাহুতি দিয়ে বিজয়াদশমীতে অগ্নি তথা তিনটি নবপত্রিকা সমেত তিন পটেশ্বরী ঠাকুরাণীর বিসর্জ্জন হতো কেবলমাত্র রাজকীয় জাঁকজমক বলিদান ব্যতীত বাকী সব নিয়মই এখনও নিয়মনিষ্ঠার সঙ্গে পালিত হয়ে আসছে
১৬২২ খ্রীস্টাব্দে মহারাজ বীরসিংহ মল্লের রাজত্বকাল থেকেই রাজধানীর মানচিত্রে বহু পটপরিবর্তন হতে থাকে পরমবৈষ্ণব মহারাজ বৃন্দাবন তীর্থ ঘুরে আসার পরেই রাজধানীতে 'নব বৃন্দাবন' স্থাপনের মানসে একের পর এক মন্দির(মল্লেশ্বর, শ্যামরায়, জোড়াবাংলা), মঞ্চ(দোলমঞ্চ, রাসমঞ্চ), জলাশয়(রাধাকুণ্ড, শ্যামকুণ্ড) নির্মাণ করাতে থাকেন তাঁর আমলেই বিষ্ণুপুর ঘরানার 'টেরাকোটা' শিল্প 'বাংলা' গঠনশৈলীর স্থাপত্য নিদর্শন উন্নতির চরম শিখরে স্থান পায় মল্লবংশের ৫৩তম বংশধর মহারাজ দুর্জন সিংহদেব(১৬৮২ খ্রীস্টাব্দ- ১৭০২ খ্রীস্টাব্দ)-এর রাজত্বকালে পূর্বক্তো বৈষ্ণবীয় তত্ত্ব আরও প্রাধান্য পেতে থাকে মহারাজ দুর্জনও প্রকৃতিতে একজন বৈষ্ণব ছিলেন তাঁরই অন্যতম শ্রেষ্ঠ পুরাকীর্তি শ্রী শ্রী মদনমোহনের মন্দির স্থাপন(১৬৯৪ খ্রীস্টাব্দ) এবং শ্রীকৃষ্ণের নামানুযায়ী রাজ্যের নাম দেন "বাঁকাচূড়া" যা আজকে অপভ্রংশে "বাঁকুড়া" নামে পরিচিত যদিও তাঁর আগে থেকেই বহু মল্লরাজা গণ বহু বৈষ্ণবীয় ঘরাণার মন্দির বিগ্রহ স্থাপন করেন, কিন্তু মহারাজ দুর্জনের "মদনমোহন" এবং "দলমাদল" কামান সকলকে ছাপিয়ে গেছে...! সেখানে ঐতিহাসিক তত্ত্বের থেকেও ধর্মীয় আবেগ উচ্চতর স্থানে প্রতিষ্ঠিত তিনিই মৃন্ময়ী মন্দিরে পশু বলিদানের নিয়ম সম্পূর্ণ বন্ধ করে দে' পরিবর্তে কুষ্মাণ্ড, আখ ইত্যাদি বলিদানের নিয়ম শুরু করেন
কালের নিয়মে আবহাওয়ার বিকারগস্ততায় বহু পট পরিবর্তন হয়েছে তবুও, একদিকে বাঙলার দুঃখ দামোদর, অন্যদিকে দুর্ভেদ্য জঙ্গল বাঁকুড়া তথা বিষ্ণুপুরকে একটি আলাদা মর্যাদায় স্থির রেখেছে কি মুসলিম আক্রমণ, কি মুঘল শাসন, কি বর্গী আক্রমণ.... নিজের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব বজায় রেখে, সব কিছু পেড়িয়ে আজকের বিষ্ণুপুর তার প্রায় তেরোশ(,৩০০) বছরের প্রাচীন রাজবংশের গৌরবগাথা আর প্রকৃতির নিয়মে ধূলিধূসরিত শূন্য প্রাসাদের ভাঙাচোরা ইঁট, পাথরে খসে পরা চাঁই, বুকে আগলে হাতছানি দিচ্ছে হয়তো আজও সেই পাথরের বুকে কান পাতলে শোনা যাবে, সঙ্গীতজ্ঞ যদুনাথ ভট্টাচার্য্যের সুরের মূর্ছনা.....!
তথ্যসূত্র এবং চিত্রেঃ শ্রীমান্ শঙ্খ



No comments:

Post a Comment