Friday, March 29, 2019

দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দিরের ইতিহাস(Dakshineswar Kali Temple)


ঐতিহ্যের ইতিহাসপর্বঃ 

 আজ প্রাচীন ইতিহাসের সন্ধানে আমাদের পরিবারের গুরুত্বপূর্ন সদস্যা শ্রীমতী দেবযানী বসু মহাশয়া ইতিহাস লিখলেন দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দিরের ইতিহাস
 সালটি ১৮৫৫সাল ব্রিটিশ রাজত্ব তখন মধ্যগগনে দেশময় বিদেশি পণ্য বিদেশি সংস্কৃতির ছড়াছড়ি প্রাচ্য পাশ্চাত্য এই দুই ভিন্ন সংস্কৃতির সংঘাত চলছে কোথাও কোথাও এই দুই সংস্কৃতির মেলবন্ধনেরও খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে অনেক ভারতীয়রা ঝুঁকছেন খ্রিষ্টধর্মের দিকে এক নতুন বাঙালি সমাজ সংস্কৃতির উদ্ভবের ফলে প্রবল সামাজিক ধর্মীয় অস্থিরতা দেখা দিয়েছে কালাপানি পেরলে জাত যাবে এই নিষেধাজ্ঞা অগ্রাহ্য করে রামমোহন রায়, দ্বারকানাথ ঠাকুরের মতন দিকপালরা বিলেত গিয়েছেন ডিরোজিও- ইয়ংবেঙ্গল সোসাইটি হিন্দুধর্ম নিপাত যাক বলে স্লোগান তুলেছে এমন এক বিচিত্র কলকাতাতেই রানি রাসমণি ভারতের সনাতন আত্মাকে আহ্বান করলেন ওই বছরেই ৩১মে দক্ষিণেশ্বর মন্দির প্রতিষ্ঠা সম্পূর্ণ করে দ্বার খুলে দিয়েছেন সাধারণ মানুষের জন্য

 রানি রাসমনি ছিলেন দেশপ্রেমের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তাঁর ব্যক্তিত্বে চরিত্রে অসাধারণ শক্তি, তেজস্বিতা দৃঢ়তার সমন্বয় অনেক ক্ষেত্রেই কিংবদন্তীতে পরিণত হয়েছে নারী হয়েও ইংরেজদের বিরুদ্ধে তাঁর সংগ্রাম ছিল নিরন্তর দোর্দণ্ডপ্রতাপ ব্রিটিশ শাসকবর্গকে তাঁর কাছে নতিস্বীকার করতে হয়েছে  তাই তাঁর মন্দির নির্মাণ নিছকই ধর্মক্ষেত্র প্রতিষ্ঠা নয়, মাতৃমুক্তির আন্দোলনের সর্বপ্রথম পদক্ষেপ রাসমণি বৈষ্ণব হয়েও মহাশক্তির আরাধনা করেছেন
 কলকাতার জানবাজার অঞ্চলের বিশাল জমিদারি এবং ভূ-সম্পত্তির মালিক ছিলেন রানি রাসমণি বহু লোকহিতকর কাজের ফলে অল্পদিনেই হয়ে উঠেছিলেন প্রজাদের চোখের মণি একবার রাণি কাশী যাত্রা করবেন বলে ঠিক করলেন, সব আয়োজন সম্পূর্ণ যাত্রার পূর্বরাতে কালিকাদেবী জ্যোতির্ময়ী মূর্তিতে আবির্ভূতা হয়ে আদেশ দিলেন- "তোমার কাশী যাত্রার প্রয়োজন নেই, ভাগীরথীর তীরে আমার মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে পূজা ভোগের ব্যবস্থা করো আমি ওই মূর্তিতে আবির্ভূতা হয়ে নিত্য পূজা গ্রহন করব" ভাগীরথীর তীরে যেস্থান রাণির পছন্দ হল তার একদিকে ক্রিশ্চান কুঠি, অন্যদিকে মুসলমানদের কবরস্থান গাজি পীরের আস্তানা স্থানটির আকৃতি কূর্মপৃষ্ঠের মতন এমন স্থানই শক্তিসাধনার উপযুক্ত

 এখানেই দশ বছর ধরে রাণি গড়ে তুলতেন তাঁর সাধের সাধনপীঠ, দক্ষিণেশ্বর ৬০বিঘা জমির ওপর এই মন্দির তার আনুষঙ্গিক ঘরবাড়ি গড়তে নয় লক্ষ টাকা ব্যয় হয়েছিল অনিন্দ্যসুন্দর মা ভবতারিণীর কষ্টিপাথরের মূর্তি তৈরী করেছিলেন বর্ধমান জেলার দাঁইহাটের অধিবাসী নবীন ভাস্কর দক্ষিণেশ্বরের নবরত্ন মন্দির বাংলার শিল্পকলার এক অপূর্ব নিদর্শন মন্দিরের উচ্চতা একশো ফুট গর্ভগৃহে কালো পাথোরের বেদির ওপর রুপোর প্রস্ফুটিত শতদল চারকোণে রুপোর স্তম্ভ মা এখানে বেনারসী শাড়ি পরিহিতা, ত্রিনয়নী শ্যামাকালী সারাগায়ে অসংখ্য স্বর্ণরৌপ্য অলংকার বামদিকের একটি হাতে নৃমুণ্ড অপরটিতে অসি ডানদিকের দুটি হাতে বরাভয় মুদ্রা পদতলে শ্বেতপাথরের শিব বছরে তিনদিন বড় পূজা হয় দক্ষিণেশ্বরে দীপান্বিতা, রটন্তী ফলহারিণী কালীপুজো শাস্ত্রমতে কালীপুজো করতে যেসব উপাচার লাগে সবই থাকে শুধু থাকে না কারণ যেহেতু ঠাকুর রামকৃষ্ণদেব কারণ ছাড়াই পূজা করতেন মায়ের মন্দিরের উত্তরে রাধাকৃষ্ণদেবের মন্দির উল্টোদিকে সারি দিয়ে বারোটি শিব মন্দির তিন মন্দির তিন ধরনের স্থাপত্য ভবতারিণীর নবরত্ন মন্দির, দ্বাদশ শিবমন্দির আটচালা মন্দির এবং রাধাকান্তের মন্দির ইউরোপীয় ধাঁচের দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরে রানি রাসমণি সফল করেছিলেন তাঁর সর্বধর্ম-সমন্বয়ের স্বপ্ন শৈব, শাক্ত বৈষ্ণব ধর্মের এক মহামিলন তীর্থ ধর্মের এই তিন ধারাকে এককরা উদারতা হলেও এমন দুঃসাহসের কাজ সম্ভব হয়েছিল রাসমণির অতুলনীয় প্রতিভার জন্যই মন্দির সম্পূর্ণ হওয়ার পর মূর্তি প্রতিষ্ঠার দিন খুঁজছিলেন রানি এমন সময় মায়ের প্রত্যাদেশ-"যত শীঘ্র পারিস আমাকে প্রতিষ্ঠা কর" এরপর রানি ১৮৫৫সালের ৩১মে স্নানযাত্রার দিন মন্দিরে মায়ের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এসেছিলেন সমগ্র বাংলাে পণ্ডিতরা মায়ের পূজক হয়ে এলেন রামকুমার চট্টোপাধ্যায় সঙ্গে এলেন ভ্রাতা গদাধর কালের ইতিহাসে ঘটে গেল যুগান্তরকারী ঘটনা

 দক্ষিণেশ্বর মন্দির প্রতিষ্ঠা বাংলার ইতিহাসে এক অনন্য ঘটনা রানি বুঝেছিলেন সমাজের সংস্কার করতে হলে শুরু করতে হবে ধর্মের হাত ধরেই ভারতের সনাতন শক্তিসাধনাকেই নতুন তাৎপর্য মাত্রা দান করার জন্যই তাঁর আবির্ভাব ভারতমায়ের মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপ দেওয়ার মতন কতই বিপ্লবী এসেছেন মহামায়ার পদতলে ঋষি অরবিন্দকে যখন পুলিশ গ্রেপ্তার করে তখন তাঁর কাছে পাওয়া গিয়েছিল একমুঠো মাটি-সে মাটি দক্ষিনেশ্বরের মাটি
 রানি রাসমণি যেন ভারতের অগ্নপুরুষের আবির্ভাবের জন্যই এই পীঠ নির্মাণ করেছিলেন সবার অলক্ষ্যে মন্দির প্রতিষ্ঠার দিন ঘটেছিল সেই তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা সে এক আশ্চর্য সংযোগ মন্দিরে মায়ের মূর্তি প্রতিষ্ঠা চলছে, এক বছর আঠারোর সাধারণ চেহারার যুবক একপাশে দাঁড়িয়ে সব দেখছেন কে জানত এই যুবকটিই হয়ে উঠবেন নিঃশব্দে ধর্মবিপ্লবের অন্যতম পথিকৃৎ, হয়ে উঠবেন যুগাবতার শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব রামকৃষ্ণ এলেন মায়ের পূজারি হয়ে মন্দিরে ত্রিশ বছর থেকেছেন এখানে রানির মন্দির গড়ে তোলার উদ্দেশ্যকে সফল করতে এই শক্তিসাধক দক্ষিণেশ্বরেই সাধনা করে পেয়েছেন ঈশ্বরদর্শন, হয়েছেন কল্পতরু তাঁরই ব্যাকুল আহ্বানে মহাশক্তি প্রকটিতা হয়েছেন মূর্তিতে এই সাধনপীঠেই নরেন্দ্রনাথের মধ্যেই বিবেকানন্দকে জাগ্রত করেছেন তিনি দক্ষিণেশ্বরেই ছিলেন মহাকালীর মানব-অবতার শ্রীসারদা মা বিবেকানন্দের জ্যান্ত দুর্গা

 বিগত দেড়শো বছর ধরে দক্ষিণেশ্বর মন্দির বাংলার ধর্ম সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করে চলেছে তখন ছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ, রাসমণি, সারদা মা ছিল খোলার চালের ঘর ছিলনা শান বাঁধানো দালান, গঙ্গার ঘাট গঙ্গার জোয়ারের সময় জল এসে আছড়ে পড়ত দ্বাদশ শিবমন্দিরের পিছনের দেওয়ালে এখন গঙ্গার পাড় বাঁধিয়ে সংস্কার করা হয়েছে উঠানের উত্তর-পশ্চিমে রামকৃষ্ণদেবের ঘর-এখানেই তাঁকে ঘিরে রাখতেন তখনকার দিকপালরা এই ঘরেই বিবেকানন্দ দেখেন তাঁর ধর্মগুরুকে এখন তা সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা হয়েছে দর্শনের জন্য অদূরেই নহবতখানা; সকাল-সন্ধে দুবার সানাইয়ের সুর ভাসিয়ে নিয়ে যেত মন্দির চত্বর পরে এই নহবতই হয় সারদা মায়ের বাসস্থান, জীবন্ত শক্তিপীঠ এখন সেখানে সারদা মন্দির নহবতের পাশেই বকুলতলার ঘাট শেষরাতে মা সারদা স্নান করতেন এখানে এই ঘাটেই এসেছিলেন ভৈরবী যোগেশ্বরী, পরমহংসদেবের তন্ত্রসাধিকা যে পঞ্চবটী রচনা করেছিলেন রামকৃষ্ণ স্বয়ং, সেখানে এখন বাঁধানো রাস্তা, সিমেন্টের বসার জায়গা হারিয়ে গেছে সেই ঘন জঙ্গল যেখানে বাহ্যজ্ঞানলুপ্ত হয়ে শ্রীরামকৃষ্ণ সাধনা করতেন
 এখান সাধন কুঠিরে তোতাপুরী বেদ শিক্ষা দেন রামকৃষ্ণকে সাধন কুটিরকে মন্দির কর্তৃপক্ষ স্মরণকক্ষে পরিণত করেছেন পঞ্চবটীর পাশেই ঝাউতলা, আগে বলা হত দিশাজঙ্গল বর্তমান ট্রাস্টি বোর্ড সেখানে একটি ধ্যানকক্ষ তৈরী করেছেন ঝাউতলার পূর্বদিকে বেলতলা, কাছেই শ্মশান বেলতলাতেই পঞ্চমুণ্ডীর আসনে রাতের পর রাত শ্রীরামকৃষ্ণ তন্ত্রসাধনা করেছেন আগে যেখানে ছিল গোশালা, আস্তাবল, এখন সেখানে কার পার্ক সুবৃহৎ সিংহদুয়ার দিয়ে অনায়াসে আসত যেত গণ্যমান্য ব্যক্তিদের ফিটন গাড়ি, এখন আসে আধুনিক এসি লাগানো মোটরগাড়ি যে রাস্তা দিয়ে রোজ কলকাতা হাওড়া থেকে শত শত মানুষ আসেন মন্দিরে, তা ছিল কাঁচা রাস্তা, দুপাশে গভীর নর্দমা, সন্ধ্যার পর হাঁটতে গা ছমছম করত, শোনা যেত শেয়ালের ডাক দুপাশে এখন ইমারতের সারি কলকাতা থেকে ভক্তরা জলপথেও আসেন এখন গঙ্গার দুপাড়কে বেঁধেছে বিবেকানন্দ সেতু সন্ত্রাসবাদীদের রুখতে নিরাপত্তার কারণে কড়া নজরদারি সমগ্র মন্দির জুড়ে সংস্কার করা হয়েছে রাধাকান্ত মন্দির নাটমন্দির বর্তমানে দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে তৈরী হয়েছে উন্নতমানের স্কাইওয়াক যেই স্কাইওয়াক দিয়ে বহু মানুষ পৌঁছে যাবেন মায়ের মন্দিরে বর্তমান এই উন্নত পরিষেবায় বহু মানুষ উপকৃত হয়েছে
 মন্দিরের দেড়শো বছর পূর্তি উপলক্ষে বহু উন্নয়নমূলক কাজ করেছিল মন্দির কর্তৃপক্ষ সেই পরিকল্পনার নাম দেওয়া হয়েছিল-"টু রিভাইভ আওয়ার হেরিটেজ" এর প্রথম ধাপ হিসাবে মন্দিরের বলি কয়েক বছর আগেই বন্ধ করা হয়েছে মা ভবতারিণীর পুরোনো সিংহাসনটি প্রতিস্থাপিত করে নতুন সিংহাসন বসানো হয়েছে রানির আমলে তৈরী সিংহাসনটি সংরক্ষন করা হয়েছে মন্দিরে পানীয় জলের ব্যবস্থা, রাস্তা সম্প্রসারণ, কার পার্কিং জোন করা হয়েছে অতিথিশালা নির্মাণ, কথামৃত গ্রন্থের সংস্করণ ইত্যাদি বাংলার ইতিহাসে  ঐতিহ্যপূর্ণ মন্দির হিসাবে রাণি রাসমনির প্রতিষ্ঠিত মা ভবতারিণীর মন্দির আজও সমাদৃত
তথ্যসূত্র গবেষণায়ঃ শ্রীমতী দেবযানী বসু
চিত্রেঃ শ্রীমতী মৌমিতা কয়াল এবং শ্রীমান্ শুভদীপ রায় চৌধুরী




No comments:

Post a Comment