Wednesday, July 10, 2019

চৈতন্য মহাপ্রভুর আশিষে সূচনা মাহেশের রথযাত্রা


ঐতিহ্যের ইতিহাসপর্বঃ

 আজ প্রকাশিত হল বাংলার বৃহত্তম মাহেশের রথযাত্রার ইতিহাস লিখলেন পরিবারের গুরুত্বপূর্ন সদস্যা শ্রীমতী দেবযানী বসু দেখা যাক মাহেশের রথযাত্রার ঐতিহাসিক কাহিনী
বাংলার বৃহত্তম মাহেশের রথ

চৈতন্য মহাপ্রভুর আশিষে সূচনা মাহেশের রথযাত্রা সময়টা ১৫১০ সালের গোড়ার দিক, সন্ন্যাস গ্রহণের পর চৈতন্যদেব চলেছেন নীলাচলের পথে চলতে চলতে থামলেন মাহেশে মাহেশ তখন হিংস্র শ্বাপদ আর জলাজঙ্গলে ভরা অখ্যাত স্থান গঙ্গার ধারে ক্ষুদ্র কুটিরে জগন্নাথদেবের মূর্তি দেখে ভাবে বিহ্বল হয়ে পড়েন মহাপ্রভু যে দেবমূর্তি দেখে তিনি অচৈতন্য হয়ে পড়েন তার প্রতিষ্ঠা হয় কিছু বছর আগে মন্দিরের ইট, কাঠ, পাথর আজও সেই কাহিনী শোনায় সাধক ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারী জগন্নাথ দর্শনে এসেছেন পুরীধামে স্বহস্তে ভোগ নিবেদন করার বাসনা তাঁর কিন্তু পুরীর পাণ্ডারা ভোগ দিতে দিলেন না দুঃখে, অপমানে, অনশনে প্রাণত্যাগ করাই স্থির করলেন ধ্রুবানন্দ তিনদিনের দিন ইষ্টদেবের স্বপ্নাদেশ পেলেন "ধ্রুবানন্দ তুই মাহেশে ফিরে যা
 ভাগীরথীতে ভেসে আসা নিমকাঠ দিয়ে জগন্নাথ, সুভদ্রা, বলরামের মূর্তি তৈরী করে সাধনভজন কর আমি তোর হাত থেকে ভোগ গ্রহণ করার জন্য আগ্রহে অপেক্ষা করবো" ফিরে এলেন ধ্রুবানন্দ এক এক বর্ষণমুখর রাতে বিদ্যুতের ঝলকানিতে ভেসে এল নিমকাঠ এক সূত্রধর গড়ে দিলেন মূর্তি শুরু হল ধ্রুবানন্দের সাধনা
 চৈতন্যদেব যখন মাহেশে আসেন ধ্রুবানন্দ তখন অন্তিম শয্যায় তাঁর কাতর অনুরোধে চৈতন্যদেব দ্বাদশ গোপালের পঞ্চম গোপাল ঠাকুর কমলাকর পিপলাইকে মন্দিরের সেবাপুজোর ভার অর্পণ করেন সুন্দরবনের আন্তর্গত খালিজুলি প্রদেশের জমিদার শ্রীধরের পুত্র কমলাকর নবদ্বীপে এসেছিলেন ন্যায়শাস্ত্র পড়তে ক্রমে তিনি চৈতন্যদেবের অত্যন্ত প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠেন পরবর্তীকালে তাঁর পার্ষদ হন, হন চৌষট্টি মোহন্তর প্রথম মহন্ত মাহেশের জগন্নাথের ভার গ্রহণ করে এখানেই থেকে যান কমলাকর পিপলাই বংশানুক্রমে তাঁর উত্তরাধিকারীরা মাহেশের সেবাইত অধিকারী নামে পরিচিত হন আজও সেই ধারা অব্যাহত

 কালের গতিতে ভাগীরথীর পশ্চিম পাড় ভাঙ্গতে থাকায় মন্দিরের গর্ভগৃহটি নদীতে তলিয়ে যাবার আশঙ্কা দেখা যায় সেইসময় কলকাতার এক বিত্তবান ব্যবসায়ী নয়নচাঁদ মল্লিক গঙ্গার পাড় থেকে মন্দির সরিয়ে নিয়ে আসেন মাহেশের রাজপথ অর্থাৎ জিটি রোডের ওপরে এখন মাহেশে যে মন্দির ঘিরে রথযাত্রা, পুজো, মেলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলে সেই নয়নচাঁদের তৈরী মন্দির সামনে নাটমন্দিরও তৈরী করে দেন তিনি, শুধু তাই নয় কয়েক বিঘা জমিও জগন্নাথ জীউ ট্রাস্টি বোর্ডকে লিখে দিয়েছিলেন নয়নচাঁদ তাঁর পিতা নিমাইচরণের নাম মন্দিরের সামনের ফলকে খোদাই করা রয়েছে, তাঁরা আজও মন্দিরের ব্যয়ভার বহন করছেন মন্দির তৈরী করতে খরচ করেছিলেন ২০,০০০ টাকা
কমলাকরের হাত ধরেই মাহেশের রথযাত্রার সূচনা পুরী থেকে জগন্নাথের রথযাত্রার সমারোহ দেখে এসে তাঁর মনে ইচ্ছে জাগে মাহেশেও রথযাত্রার আয়োজন করবেন মাহেশের বর্তমান সেবায়েত সৌমেন অধিকারী স্মৃতিরোমন্থণ করতে করতে জানিয়েছিলেন পুরোনো ইতিহাস-"পুরীর পর এটিই ভারতের দ্বিতীয় পশ্চিমবঙ্গের প্রাচীনতম রথযাত্রা" রথের দিন দু-তিন লক্ষ ভক্তের টানে মহাপ্রভুর রথ সচল হয় জিটি রোড ধরে দেড় কিমি পথ পেরিয়ে মহাপ্রভু যান শ্রীরামপুরের গুচিন্ডা বাড়ি ভক্তরা পুজো দেয়, প্রসাদ পায় রথ থেকে ভক্তদের জন্য ছোড়া হয় প্রসাদী কলা, বাতাসা, নকুলদানা দূর দূরান্ত থেকে দলে দলে লোক আসে মাহেশের রথযাত্রা দর্শন করতে সঙ্গে থাকে একমাস ব্যাপী মেলা আর মেলার নানা আকর্ষণ পুরীর পর রথযাত্রাকে কেন্দ্র করে এমন সমারোহ পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া কোথাও দেখা যায় না অনেকে বলেন কমলাকর পিপলাই-এর সময়ে জগন্নাথদেব পাশের গ্রাম বল্লভপুরের মাসির বাড়িতে আসতেন রথে চড়ে পড়ে গঙ্গার ভাঙ্গনের ফলে সেই মন্দির পরিত্যাক্ত হওয়ার নতুন মন্দিরে বিগ্রহ স্থানান্তরিত হয়
 বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের "রাধারানী" উপন্যাসের মধ্য দিয়ে মাহেশ বাংলায় নতুন ভাবে গুরুত্ব পায় কারণ এই উপন্যাস লেখার পেছনে বঙ্কিমচন্দ্রের শৈশবে দেখা রথের মেলার স্মৃতি জড়িয়ে ছিল বঙ্কিমচন্দ্র তখন খুব ছোটো, জমিদার পিতার হাত ধরে এসেছিলেন মাহেশের রথ দেখতে তখন গ্রাম হিসাবে মাহেশ যেমন অখ্যাত,  রথের মেলাও সাধারণ এই মেলাতেই বঙ্কিমচন্দ্র খুঁজে পান রাধারানীকে দুঃখিনী একাদশ বর্ষীয়া সেই বালিকা ফুলের মালা গেঁথে বিক্রি করতে এসেছিল সেই মেলায় এক পয়সার মালা বিক্রি করে অসুস্থ মায়ের পথ্য যোগার করার কথা ভেবেছিলেন রাধারানী সন্ধ্যাবেলা হঠাৎ শুরু হয় প্রবল ঝড়বৃষ্টি ফলে মেলা ভেঙে যায় পথ হারিয়ে কাঁদতে থাকে সে, সেই সময় স্থানীয় এক জমিদার রাধারানীর সমস্ত মালা কিনে নেন তাকে বাড়িতে নিয়ে আসেন সম্ভবত সেই জমিদার ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্রের পিতা শৈশবের এই ঘটনা বঙ্কিমের স্মৃতিতে অটুট ছিল তাই তিনি পরবর্তী সময়ে রাধারানী উপন্যাসটিকে এই ঘটনার মধ্য দিয়ে মেলে ধরেছেন রাধারানীর মধ্য দিয়ে মাহেশ বাংলায় নতুন ভাবে গুরুত্ব পায় আজও মাহেশের মেলায় অনুভব করা যায় কিশোর মেয়েটির দীর্ঘনিঃশ্বাস

ধীরে ধীরে মাহেশের মেলার জনপ্রিয়তা বেড়েছে এসেছেন বহু মনিষী ঠাকুর রামকৃষ্ণদেব দক্ষিণেশ্বর থেকে সারদা মা, ভক্তকবি গিরিশচন্দ্র, গোপাল-মা প্রমুখদের সঙ্গে নিয়ে রথের সময় বেশ কয়েকবার মাহেশে এসেছিলেন এমন বহু মহাপ্রাণের পদধূলিতে ধন্য মাহেশ আজ তীর্থভূমিতে পরিণত
 পুরীকে বলা হয় নীলাচল, আর মাহেশের অন্য নাম নব নীলাচল এক হাজার শালগ্রাম দিয়ে তৈরী রত্নবেদীতে প্রতিষ্ঠিত তিন দেবতা নব নীলাচল আরও এক মাহাত্ম্যে আলাদা নীলাচল থেকে পুরীতে তিন দেবতা দাঁড়িয়ে আছেন এক লক্ষ শালগ্রাম শিলার ওপর তৈরি বেদীতে কিন্তু মাহেশে মহাপ্রভু, সুভদ্রা বলভদ্র বেদিতে উপবিষ্ট আছেন প্রতি বারো বছর অন্তর পুরীতে নিমকাঠ দিয়ে নতুন মূর্তি তৈরি করে অভিষেক হয় মাহেশে ৬১৯ বছর একই মূর্তিতে চলছে তবে প্রতিবছর স্নানযাত্রার পর প্রভুর অঙ্গরাগ হয় কলকাতার পাথুরিয়াঘাটা থেকে বংশপরম্পরায় ভাস্কর আসেন তিনমূর্তির নবযৌবন দিতে টানা তিনদিন মন্দিরের দরজা বন্ধ করে শিল্পী এই কাজ করেন এইসময় নিজের চুল মুখ গামছা, কাপড়ে আচ্ছাদিত করে, একসন্ধ্যা আহার করে কাজটি সম্পন্ন করেন ব্যবহার হয় সমস্ত প্রাকৃতিক রঙ গাছগাছালির সংগৃহীত রঙ দিয়ে ভগবানকে নতুন রূপ দেন শিল্পী অজস্র সোনা-রুপোর গহনা সোনার হাত লাগিয়ে সুসজ্জিত করা হয় জগন্নাথ সহ তিন দেবদেবীকে
ঘড়ির কাঁটা ধরে মাহেশে পুজো ভোগ দেওয়া হয় জগন্নাথদেবকে প্রতিদিনের ভোগরাগেও বিশেষত্ব রয়েছে মাটির উনুনে একপাকে রান্না হয় ভোগ ব্যবহার হয় শুধুই গঙ্গাজল জগন্নাথদেবের ভোগ কখনও এঁটো হয় না অর্থাৎ যে কোন অবস্থাতে যে কোনও মানুষ এই ভোগ গ্রহন করতে পারেন বিধবারাও এই ভোগ গ্রহণ করতে পারেন মাহেশে প্রতিদিন প্রভুকে খিচুড়ি, ডাল, চাটনি, পায়েস পরিবেশন করা হয় বিশেষ বিশেষ দিনে থাকে বিশেষ পদের আয়োজন প্রভুর অতিপ্রিয় একটি পদ হয় মালপোয়া অতি সামান্য তেল-মশলায় ভোগ রান্না হয় কিন্তু স্বাদে গন্ধ অতুলনীয় মাহেশের ভোগ সন্ধ্যারতির সময়ে ভোগে থাকে লুচি-হালুয়া লুচি সাধারণ লুচি নয়, হাতিপায়া-লুচি, অর্থাৎ হাতির পায়ের মতন বৃহদাকার লুচিই এখানকার বিশেষ পদের একটি


যুগের সাথে মাহেশ বদলেছে, কমলাকরের সময়কার মন্দিরও নেই, রথও নেই মাহেশে প্রথম দিকে যে রথ ব্যবহার হত, তা নষ্ট হলে ১৭৯৩ সালে শ্রীরামকৃষ্ণের পার্ষদ বলরাম বসুর পিতামহ কৃষ্ণরাম বসু সুদৃশ্য কাঠের রথ তৈরী করে দেন কালক্রমে এটিও জীর্ণ হলে এই পরিবারই তার পুনঃনির্মাণ করে দেন সে রথটি কয়েকবছর পর দুর্ঘটনায় অগ্নিদগ্ধ হয় ১৮৫২ সালে পুনরায় নতুন রথ নির্মাণ করেন কালাচাঁদ বসু একদিন এই ব্যক্তি এতে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করলে রথটি পরিত্যক্ত হয় ১৮৫৬ সালে তৈরি হয় নতুন রথ, এটিও কয়েক বছরের মধ্যে অগ্নিকাণ্ডে ধ্বংস হয় এবার আর কাঠের নয়, লোহার রথ তৈরি হয় ১৮৮৫ সালে হুগলির দেওয়ান কৃষ্ণচন্দ্র বসু মার্টিন বার্ণ কোম্পানী থেকে রথটি তৈরি করেন এই পরিবারই এখনও রথের দেখাশোনা করেন
 ৪৫ফুট উঁচু এই রথই রথযাত্রার সমস্ত আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু রথের ওজন ১২৫ টন বিশাল বিশাল ১০টি লোহার চাকায় পথ চলা ৯টি চূড়া বিশিষ্ট রথটি নবরত্ন ধারায় নির্মিত সামনের দিকে দুটি তামার ঘোড়া, একটি নীল অন্যটি সাদা থাকে কাঠের সারথি দুটি রাজহাঁস

 ৯টি চূড়ার প্রধানটিতে জগন্নাথদেবের অবস্থান নবযৌবন অবশেষে রাজবেশে তিন দেবতা রথে চড়ে নামে ভক্ত সমুদ্রে আড়াই-তিন ঘন্টা ধরে তিনি একটু একটু করে পথ চলেন উল্টোরথে একই ভাবে রথ টানা হয় জগন্নাথদেব ফিরে আসেন মাহেশে এইভাবে বছর বছর ভক্তজনের মনের টানে মাহেশে রথযাত্রা হয়ে আসছে
তথ্যসূত্র সংগ্রহেঃ শ্রীমতী দেবযানী বসু(সাংবাদিক)
চিত্রঋণঃ শ্রীমান্ বিশ্বরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়


No comments:

Post a Comment