রত্নগর্ভা
ভারতভূমিঃ
প্রকাশিত
হলো মীরাবাঈয়ের জীবনী। তথ্য
সংগ্রহে শ্রীমান শঙ্খ।
"নিত
নহানে সে হরি মিলে
তো জলজন্তু হোই।
ফলমূল
খাকে হরি মিলে তো
বন্দর হোই।।
তীরণ ভখন-সে হরি
মিলে তো বহুত মৃগী
অজা।
স্ত্রী
ছোড়কে হরি মিলে তো
বহুত হৈ খোজা।।
দুধ পিকে হরি মিলে
তো বহুত বৎসবালা।
মীরা কহে বিনা প্রেমসে
ন মিলে নন্দলালা।।"
হরবিলাস
সর্দা কৃত 'মহারাণা সাঁগা'
নামক গ্রন্থের প্রথম ভাগে উল্লেখ
করা হয়েছে যে, ১৪৯৮
খ্রীস্টাব্দের কাছাকাছি কোনো সময়ে কৃষ্ণগতপ্রাণা
মীরাবাঈ আবির্ভূত হয়েছিলেন। তাঁর
আগেপিছে অত্যল্পকালের ব্যবধানে বিরাজ করছিলেন সঙ্গীতগুরু
মিঞা তানসেন, ভক্তশ্রেষ্ঠ সুরদাসজী এবং তুলসীদাসজী।
তানসেনের গুরু ছিলেন সুরসাধক
বৈজু বাওরা। এককথায়
এইসব সর্বজনপূজ্য ভারতরত্নগণ ছিলেন সমসাময়িক, সকলেই
ষোড়শ শতকের ব্যক্তিত্ব, প্রত্যেকেই
প্রত্যেকের পরিচিত এবং ঘনিষ্ঠ
ছিলেন। সুরদাসজী
তাঁর প্রসিদ্ধ 'সুরসাগর' গ্রন্থে বহু ভক্তিমূলক গান
রচনা করে গেছেন।
তাঁর ভক্তদের বিশ্বাস যে, সুরদাসজী স্বয়ং
উদ্ধবের অবতার ছিলেন এবং
সেইকারণেই তিনি শ্রীকৃষ্ণকে আজীবন
সখা হিসাবে পূজা করে
গেছেন। মিঞা
তানসেন এবং সুরদাসজী অন্তরঙ্গ
বন্ধু ছিলেন। পরস্পরের
মধ্যে সঙ্গীতের মাধ্যমে পত্রবিনিময় হ'তো।
যেমন একবার ফতেহপুর সিক্রি
থেকে তানসেন সুরদাসজী'কে
চিঠি লিখে পাঠানঃ
"কি
ধোঁ সুরকো শর লগেও
কী ধোঁ সুর কী
পীর,
কি ধোঁ সুর কি
তন লগেও তনমন দহত
শরীর।"
অর্থাৎ,
আমার অঙ্গে কি সুরের
তীর এসে বিঁধলো নাকি
সুরদাসের বিরহবেদনা ব্যথিত করলো? আজ
কি সুরদাসের সঙ্গে আমার আন্তরিক
সত্তার মিলন হ'লো
যে, আমার মনে একটি
অব্যক্ত অনুভূতির স্ফূরণ হচ্ছে?
উত্তরে
সুরদাসজী লিখে পাঠান,
"বিধ্'না এহ্ জিয়া
কর, শেষ ন দিন্থো
কান,
ধরা মেরু সব ডোলেতো,
তানসেন কি তান।"
অর্থাৎ,
বিধাতা একথার পূর্বাভাস পেয়েই
শেষ'কে (বাসুকীনাগকে, যাঁর
মাথায় বিশ্বচরাচরের ভার রয়েছে) শ্রবণেন্দ্রিয়
দান করেননি। কেননা,
শেষনাগকে কর্ণ দান করলে
তিনি তানসেনের অপূর্ব সঙ্গীত শুনে
মাথা দোলাতেন আর সমগ্র ব্রহ্মাণ্ড
দুলে উঠে চুরমার হয়ে
যেত!
তানসেন
প্রশংসা করেছিলেন সুরদাসের মধুনিস্যন্দিনী ভাষার এবং সুরদাস
প্রশংসা করেছিলেন তানসেনের সুধানিস্যন্দিনী সুরমাধুর্য্যের। এমনই
ছিলো উভয়ের প্রতি উভয়ের
অনুরাগ!
ঠিক এরকমই মহাযোগিনী মীরাবাঈয়ের
সঙ্গে মহাত্মা তুলসীদাসজী'র নিয়মিত পত্রালাপ
ছিলো। যখন
কৃষ্ণপ্রেমে পাগলিনী মিরাবাঈকে শ্বশুরকুলের পক্ষ থেকে নানারকম
উৎপীড়ন ও নির্যাতন করা
আরম্ভ হলো, তাঁর সাধনপথের
জয়যাত্রায় নানারকম বিঘ্নবিপদ এসে পড়লো, তখন
তিনি দুঃখ দুশ্চিন্তায় একেবারে
ভেঙে পড়েন। অনেক
ভেবেচিন্তে তিনি গোঁসাই তুলসীদাসজী'কে পত্র লেখেন,
"শ্রীতুলসী
সুখনিধান, দুখহরণ গোঁসাঈ,
পায়ের
পর প্রণাম করু, অবহরো
শোকসমুদাই।
ঘর কে স্বজন হমারে
যেতে সবনে উপাধি বাঢ়াই,
সাধুসঙ্গ
অরু ভজন করত মোহি
দেত কলেশ মহাই।
বালপনসে
মীরা কানহা গিরিধরলাল মিতাই,
সো তো ছুটত নহি
কৈঁসে, লগন লগি বরিয়াই।
মেরে মাতাপিতাকে সম হো, হরিভক্ত
ন সুখদাই,
হমকো কহা উচিৎ করিয়ে
হয় সো লিখিয়ে সমঝাই।"
অর্থাৎ,
হে দুঃখহরণ সুখনিধান গোস্বামী তুলসীদাস! আমি বারংবার তোমাকে
প্রণতি জানাচ্ছি। তুমি
আমার সকল শোক হরণ
করো। আমার
স্বজন আমার নামে মিথ্যা
কলঙ্ক রটনা করছে, আমাকে
ভজন ও সাধুসঙ্গ করতে
অনেক ক্লেশ দিচ্ছে।
শৈশব হ'তে মীরা
গিরিধারীলালের সঙ্গে প্রেম করেছে
এবং তা ক্রমেই গভীর
হয়েছে। অনেক
চেষ্টা করেও তাঁকে ছাড়তে
আমি অপারগ। তুমি
আমার পিতামাতা সদৃশ এবং হরিভক্তদের
পরম হিতাকাঙ্ক্ষী। তুমি
আমাকে বুঝিয়ে লিখে পাঠাও,
এ অবস্থায় আমার কী করা
উচিৎ!
এর উত্তরে গোস্বামী তুলসীদাসজী
লিখে পাঠান,
"যাকে
প্রিয় না রামবৈদেহী।
তজিয়ে
তায় কোটি বৈরীসম, যদ্যপি
পরম সনেহী।
তজে পিতা প্রহ্লাদ, বিভীষণ
বন্ধু, ভরত মহতারী।
বলি গুরু তজে, কান্ত
ব্রজবনিতা ভয়ে সব মঙ্গলকারী।
না তো নেহ রাম
সো মনিয়ত, সুহৃৎ সুসেব্য
যহাঁলো;
অঞ্জন
কহাঁ আঁখ সো ফুটে
বহুতক্ কাঁহা কহাঁলো।
তুলসী!
সো সব ভাঁতি পরমহিত,
পূজ্য প্রাণতে প্যারো;
যা সোঁ হোয় সনেহ
রামপদ এহি মতো হমারো।।"
অর্থাৎ,
তোমার রামনাম নেওয়ার পথে
যে বাধা জন্মায়, সে
যদি তোমার পরম স্নেহাস্পদও
হয় তবুও তাকে তুমি
কোটি বৈরী অর্থাৎ, পরমশত্রু
জ্ঞানে অবিলম্বে ত্যাগ করবে।
প্রহ্লাদ পিতাকে, বিভীষণ বন্ধুকে, ভরত
মাতাকে, বলি গুরুকে, ব্রজবনিতাগণ
নিজেদের স্বামীদের'কে, ভগবৎ-আরাধনায়
বিঘ্নজ্ঞানে চিরদিনের মতো ত্যাগ করেছিলেন
এবং তাতেই তাঁদের পরম
মঙ্গল হয়েছিলো। চোখে
জ্ঞানাঞ্জন লাগালে চোখের দীপ্তি
উজ্জ্বল হয় এবং রামপদে
ভক্তি বাড়াবার জন্য যদি পরম
সুহৃদকে ত্যাগ করতে হয়
তবে তাও ত্যাগ করবে। আমি
আর তোমায় কত বোঝাবো!
যেসব কাজ করলে রামের
উপর তোমার অচলা ভক্তি
হয় তা তুমি অবিলম্বে
করবে-- এই আমার মত।
মাড়োয়ার
দেশে মেড়তা পরগণার অধিপতি
ছিলেন সামন্তরাজ রতন সিংহ রাঠোর। তাঁরই
কন্যা ছিলেন মীরা।
মীরার জন্ম হয়, মেড়তা
পরগণার কুড়কিগ্রামে। বাল্যকাল
থেকেই অসাধারণ রূপবতী মীরার সৌন্দর্য্যে
এক অপার্থিব করুণাভক্তির বিচ্ছুরণ ঘটতে থাকায় যে'ই তাঁকে দেখতো
তারই মনে পবিত্রভাবের স্ফূরণ
হ'তো। এই
সৌন্দর্য্যের সাথে মীরার কণ্ঠস্বরে
এমন এক মোহিনী মাধুরী
ও সঙ্গীতে সহজপটুত্ব ছিলো যে আপনমনেই
বহু ছন্দবদ্ধ পঙক্তি বাল্যকাল থেকেই
রচনা করে যেতেন।
আর আর সব গানের
মধ্যে হরিগুণ গাথাই গাইতে
তিনি সবথেকে বেশী ভালোবাসতেন।
বাল্যকালে
কোনো প্রতিবেশী কন্যার বিবাহোৎসব দেখে
নিজের মা'কে জিজ্ঞেস
করেন, "আমার স্বামী কে?"
মাতাজী গৃহদেবতা গিরিধারীলালের বিগ্রহ দেখিয়ে মীরাকে
বলেন, "ঐ যে তোর
স্বামী"। বালিকা
মীরা সেদিন থেকেই গিরিধারী'কে স্বামী জেনে
হৃদয়ের সমস্ত প্রেম ও
ভক্তি দিয়ে পূজা করতে
শুরু করেন। এইভাবেই
বিশ্বপতি জগন্নাথ মীরার পার্থিবপতি'র
আসনে ধরা দেন।
বয়োবৃদ্ধির সাথে সাথে মীরার
রূপ, গুণ এবং ভুবনমোহিনী
সঙ্গীত-খ্যাতি মাড়োয়ার ছাড়িয়ে
সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়ে।
সেই খ্যাতিতে আকৃষ্ট হয়ে বহু
ভক্তবৃন্দ সুরসাধিকার সাক্ষাৎ দর্শন ও সঙ্গীত
শ্রবণে চরিতার্থ হবার জন্য মাড়োয়ারে
আসতে থাকেন। ক্রমেই
মাড়োয়ার একটি তীর্থস্থানে পরিণত
হয়।
চিতোরের
মহারাণা সংগ্রামসিংহের পুত্র ভোজরাজ মীরার
সুখ্যাতি শুনে তাঁকে দেখার
জন্য উৎসুক হয়ে পড়েন
এবং একদিন ছদ্মবেশে মীরার
পিতৃগৃহে এসে মীরার রূপ
ও কণ্ঠস্বরে যারপরনাই অভিভূত হ'ন। অতঃ
নিজের আসল পরিচয় দান
করেন এবং দু'তিন
অতিথিরূপে থাকার পরে বিদায়
নেন। বিদায়ের
লগ্নে আত্মবিস্মৃত হয়ে মীরার অঙ্গুলিতে
একটি মহামূল্য হীরকাঙ্গুরীয় পড়িয়ে দিয়ে বলেন,
"মীরা, তোমার সঙ্গ স্বর্গসুখতুল্য। এই
স্বর্গ ছেড়ে চিতোরে যেতে
মন চাইছে না।
তুমি যদি চিতোরের ভবিষ্যৎ
রাজমহিষী হ'তে স্বীকার
করো তাহলে চিতোর ও
মহারাণার কুল ধন্য হয়।" মীরার পিতৃদেব
পূর্বেই অতিথির পরিচয় পেয়েছিলেন। অতএব
সানন্দেই ভোজরাজের হাতে কন্যাকে সম্প্রদান
করলেন। স্বচ্ছন্দবিহারিণী
বিহঙ্গী, বন্দিনী হলেন স্বর্ণপিঞ্জরে!
মীরার
শ্বশুরকুল ছিলেন শাক্ত(মতান্তের
শৈব)। জনপ্রবাদ
এই যে, মীরা শ্বশুরবাড়ীতে
আনীত হলে তাঁকে কুলদেবতা/দেবীর বিগ্রহ প্রণাম
করতে বলা হয়।
তখন তিনি সেই আদেশ
প্রত্যাখ্যান করে বলেন, "এক
গিরিধারীলাল ব্যতীত আর কাউকে
আমি প্রণাম করি না।".............. ক্রমশ
No comments:
Post a Comment