Sunday, July 28, 2019

আভিজাত্যে বাকুলিয়া হাউসঃ-


ঐতিহ্যের ইতিহাসপর্বঃ
 আজ প্রকাশিত হল খিদিরপুর বাকুলিয়া হাউসের কন্যারূপিণী মা দুর্গার ইতিহাস লিখলেন বনেদীয়ানার গুরুত্বপূর্ণ সদস্যা শ্রীমতী দেবযানী বসু মহাশয়া চলুন দেখা যাক সেই পরিবারের ইতিহাস
আভিজাত্যে বাকুলিয়া হাউসঃ-
তিনশ বছরের কিছু আগেও কলকাতা যখন ছিল তিনটি গ্রাম মাত্র তখন উত্তরের সুতানুটিতেই বেশ কিছু বনেদী পরিবার দুর্গাপুজো করতো তাদের কেউ ছিল রাজা কেউ জমিদার কিন্তু দক্ষিণের ডিহি কলকাতা বা গোবিন্দপুর অঞ্চলও পিছিয়ে ছিল না সংখ্যায় হয়ত কম, কিন্তু খিদিরপুর, বড়িশা অঞ্চলেও বাস করত এমন অনেক পুরানো নিষ্ঠাবান অতিথিবৎসল পরিবার যাদের পুজোতেও খুঁজে পাওয়া যায় ভারতের প্রাচীন ঐতিহ্যের গন্ধ তেমনই এক পুজো হয় খিদিরপুরের বাকুলিয়া হাউসে মুখার্জি পরিবারে এখানে মা আসেন কন্যারূপে মাতৃরূপে নয় মেয়ের আগমনে সাড়া পড়ে যায় বাকুলিয়া হাউসের অন্দরে, বাইরে তবে বাহ্যিক আড়ম্বর নয় নিয়মনিষ্ঠা মেনে পুজো অতিথি আপ্যায়নই পরিবারের প্রধান বৈশিষ্ট্য
 ১৮৫২ সালে পুজোর শুরু বাকুলিয়া হাউসে বাড়ির প্রতিষ্ঠাতা বিশ্বেশ্বর মুখোপাধ্যায় সেই বছর শারদীয় পুজোর কয়েকদিন আগে সস্ত্রীক গ্রামের বাড়িতে যান এই সময় তাঁর স্ত্রী ছিলেন সন্তানসম্ভবা তাদের আদি গ্রাম ছিল হুগলি জেলার বাকুলিয়া গ্রামে সেখানে তার দাদা কাশীশ্বর মুখোপাধ্যায় ভ্রাতৃবধূর আসন্ন সন্তান প্রসবের কথা জানতে পেরে উৎকণ্ঠীত হয়ে পড়েন যদি অশৌচের কারণে পুজো বন্ধ হয়ে যায়, তাই ভাইকে অপ্রীতিকর কথা শোনান অভিমানে বিশ্বেশ্বরবাবু স্ত্রীকে নিয়ে কলকাতায় ফিরে আসেন এবং তিনদিনের মধ্যে বাড়িতে দুর্গাপুজোর বন্দোবস্ত করে ফেলেন সেই হিসাবে বাকুলিয়া হাউসের পুজো এবছর ১৬৭বছরে পা দিতে চলেছে
পুজোকাহিনী বলার আগে পরিবারের আরও কিছু কথা না বললেই নয় এতবড় একান্নবর্তী পরিবার আজ কলকাতায় বিরল জ্যাঠতুতো খুড়তুতো ভাই, তাদের পরিবার মিলিয়ে প্রায় ৫০জনের মত সদস্য এদের সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা এখনও রান্নাঘর ভাগ হয়নি বাড়ির সদস্য, ঠাকুর চাকর মিলিয়ে ১০০জনের পাত পড়ে প্রতিদিন এর ভিত্তি মনে হয় পরিবারের সাবেকিয়ানা বাড়ির কুলদেবতা শ্রীঁধর বানেশ্বর পূর্ণ মর্যাদায় সমাদৃত অনেক মহান ব্যক্তিত্ব যেমন নেতাজী, ডঃবিধানচন্দ্র রায়, প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের পদধূলিতে ধন্য বাড়ি
 জন্মাষ্টমীর পর গেলেই দেখা যাবে ঠাকুরদালানে চিন্ময়ী মা মৃন্ময়ীরূপ পাচ্ছেন জন্মাষ্টমীর দিন মায়ের দক্ষিণ পদের বাঁশটি পুজো করে ঠাকুর গড়া হয় আদিকাল থেকে একই নিয়মে প্রতিমা গড়ছেন বংশানুক্রমিক কুমোরেরা শুধু কুমোরেরা নয়, যারা দেবীর চিরাচরিত ডাকের সাজে, ঝলমলে গহনা গাঁটিতে নয়নভিরাম রূপ দেবেন তারাও আসছেন কয়েক পুরুষ ধরে একই ভঙ্গিমাতে গড়া হয় মূর্তি দেবীর ডান পা সিংহের পিঠে বাম পা অসুরের কাঁধে সিংহটি কিন্তু বৈষ্ণব রীতির সঙ্গে সাযুজ্য রেখে ঘোড়ামুখী সিংহ অদ্ভুত ব্যাপার, দুর্গার বাহন সিংহ এবং কার্তিকের বাহন ময়ূর ছাড়া বাকি কারোর বাহন নেই আরও পার্থক্য আছে অন্য পুজোর সাথে এদের গনেশ পরেন নীলাম্বর ধুতি, কার্তিক সাদা কোঁচানো ধুতি
পুজো পদ্ধতিও কিছু ক্ষেত্রে ভিন্ন ষষ্ঠীতে বোধন হয় মাকে খাওয়ানোর ব্যাপারে মুখোপাধ্যায় পরিবার কোন ত্রুটি রাখেন না বছরে একবার কন্যা আসছেন, তার রসনা তৃপ্তির জন্য আবদারের খাবার তৈরির জন্য বাড়ির মেয়েরা, বউরা এমনক ছোটো সদস্যাটিও সারক্ষণ তৎপর চারদিনে বিশাল আয়োজন রান্নার প্রতিদিন দ্বিপ্রহরে দুবার করে ভোগ হয়, একটি খিচুড়ি ভোগ, অন্যটি সাদা ভোগ রাত্রে থাকে লুচি, ভাজা, মিষ্টির শীতল ভোগ প্রত্যহ তিনরকম খিচুড়ি, ভাজা, শুক্তো, কলার বড়া, ঘিভাত, তেঁতুলের চাটনি থাকেই এছাড়া তিনদিনে আলাদা পদে সাজানো হয় ভোগ যেমন সপ্তমীতে দেওয়া হয় লাউঘন্ট, বাঁধাকপির ডালনি, অড়হর ডাল মহাষ্টমীতে মোচারঘন্ট, মানকচুর ডালনা, ছোলার ডাল, আমসত্ত্বর চাটনি মহানবমীতে থাকে কচুরশাক, কড়াই ডাল, থোড় ভাজা, চালতার অম্বল এর সঙ্গে থাকে বাড়িতে ভিয়েনে তৈরি নানান রকমের মিষ্টি দশমীর সকাল সকলের বিষাদ ভরা মন কন্যার বিদায়ের কাল যে আসন্ন এখানে মাকে দশমীতে পান্তাভোগ দিয়ে বিদায় জানানো হয় পান্তার সাথে থাকে কচুরশাক, কড়াই ডাল, ভাজা, বেগুনী, চালকুমড়োর তরকারি, চালতার অম্বল, পায়েস কেন পান্তাভোগ হয় তার পেছনে রয়েছে দুরকম কারণ একটি হল তিনদিনের এলাহি খাওয়া দাওয়ার পর অতদূরের পথে যাত্রা করবেন মা তাই শরীর ঠাণ্ডা রাখতে পান্তা আর হালকা খাবার খেয়ে যাত্রা অন্য কারণটি হল কন্যাকে শ্বশুরগৃহে জিজ্ঞাসা পান্তার বিবরণই দেবেন তাহলে কারো চোখ টাটাবে না কন্যার প্রতি পিতৃগৃহের স্নেহমায়ার এমন আদর্শ উদাহরণ সত্যই আলাদা করেছে বাকুলিয়া হাউসকে অন্যরকম প্রথা আরও আছে নবমীর সন্ধ্যায় আরতি করেন পূজারি নয়, বাড়িরই কোন সদস্য দশমীর দিনও পুরোহিতের সাথে মন্ত্রোচ্চারণে বসেন বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠরা কাঁধে করে প্রতিমা ভাসান যায় গঙ্গায় সন্ধ্যার আগেই এখানেই শেষ নয় দশমীর পরে মঙ্গল বা শনিবারে রক্ষাকালী পুজো দিয়ে শেষ হয় বাড়ির বাৎসরিক শারদীয়া উৎসব
তথ্যসূত্রঃ শ্রীমতী দেবযানী বসু(সাংবাদিক)


No comments:

Post a Comment