Friday, July 19, 2019

মীরাবাঈয়ের জীবনী

রত্নগর্ভা ভারতভূমিঃ

প্রকাশিত হলো মীরাবাঈয়ের জীবনী তথ্য সংগ্রহে শ্রীমান শঙ্খ

#প্রথম_পর্বের_লিঙ্ক

https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=2403041513265829&id=2300280956875219

#দ্বিতীয়_পর্ব

সেইদিন থেকে শুরু হলো মীরার কপালে লাঞ্ছনাভোগ চারিদিকে কেবল নিষেধের বেড়াজাল, এমনভাবে যখন তখন গলা ছেড়ে গান গাওয়া রাণীর সাজে না, অহোরাত্র ঠাকুর নিয়ে পড়ে থাকা কুলবধূর যোগ্য নয়, সাধুসন্ন্যাসীদের সঙ্গে অবাধে মেলামেশা চলবে না ইত্যাদি মীরা দুঃখে ব্যথায় ম্রিয়মনা হয়ে পড়লেন
তিনি সদা-সর্বদা হরিসংকীর্তনে মত্ত থাকায় স্বামীসেবায় ব্যাঘাত ঘটতে লাগলো রাণা রুষ্ট হলেন মীরা বৈষ্ণব মহাত্মা পেলেই তাঁর সঙ্গে ভজন-কীর্তনে মেতে উঠতেন, এতে রাণা মীরার চরিত্রে সন্দেহ করতে লাগলেন রাণা পুনরায় বিবাহ করবেন বলে ভয়ও দেখালেন তাতে বিনম্রভাবে মীরা বললেন, "আপনি পুনরায় বিবাহ করলে আমি অত্যন্ত সুখী হবো" মীরার প্রতি রাণার সন্দেহ আরও প্রবল হয়ে উঠলো এই সন্দেহের আগুনে ঘৃতাহুতি দিতে লাগলেন, মীরার ননদ শ্রীমতী ঊদাবাঈ মীরার উপর দিবারাত্র গঞ্জনা নির্যাতন চলতেই থাকলো তিনি তাঁর প্রাণের ঠাকুর গিরিধারীলালকে বুকে আঁকড়ে সব ব্যথা নীরবে সহ্য করতে লাগলেন
ইতিমধ্যে মীরার স্বামীর মৃত্যু 'লে তাঁর দেবর বিক্রমজিৎ সিংহ মহারাণার আসনে বসলেন তিনি মীরার সাধুসঙ্গ সাধন-ভজনে নানারকম বাধা সৃষ্টি করতে থাকলেন; ননদ ঊদাবাঈয়ের অত্যাচার চতুর্গুণ হলো! মীরাকে প্রাণে হত্যা করার উদ্দেশ্যে ফুলের সাজিতে কালসর্প পাঠানো 'লো কিন্তু মীরা সাজিভর্তি ফুলের মধ্যে শালগ্রামশিলা পেলেন এই অলৌকিক কাণ্ড দেখে মহারাণা বা তাঁর ভগিনী কারোরই চোখ খুললো না, চৈতন্যোদয় হলো না! পুনরায় দেবতার চরণামৃত বলে মীরাকে বিষ খাওয়ানে হলো কিন্তু এক্ষেত্রেও ভক্তকে রক্ষা করলেন ভগবান চরণামৃত জ্ঞানে মীরা সাগ্রহে সেই বিষ পান করেও সম্পূর্ণ সুস্থ রইলেন, উল্টে তাঁর ভাগবৎ প্রেমের মাদকতা আরও বৃদ্ধি পেলো হরিনাম সংকীর্তনেই ডুবে রইলেন
এইসময়েই বারংবার সাধনে ব্যাঘাত ঘটায় মীরা মহাত্মা তুলসীদাসজী কে পত্র লেখেন "তজিয়ে তায় কোটি বৈরীসম, যদ্যপি পরম সনেহী", তুলসীদাসজী' এই নির্দেশ পেয়েই তিনি আনন্দিত চিত্তে গিরিধারীলাল'কে বুকে নিয়ে চিরকালের জন্য চিতোর ত্যাগ করলেন সেই সময়কার আর্তি ভগবৎ সঙ্গসুধা মীরার প্রতিটি গানের মধ্যে যেভাবে ফুটে উঠেছিলো, তাতে পাষাণও দ্রবীভূত হয়!

"তুমহারে কারণ সব সুখ ছোড়্যা
অব কহো কেঁও তরসাবো
বিরহ বিথা লাগি উদ-অন্দর
পীতম, সো তুম আয়ো বুঝাবো।।"

অর্থাৎ, হে প্রিয়তম! তোমার জন্য যে আমি সব সুখ পরিত্যাগ করে এসেছি, এখন তুমি আমাকে গ্রহণ না করার ভয় দেখাচ্ছো? অন্তরে বিরহবেদনা জ্বলে উঠেছে, এখন তুমি এসে আমার জ্বালা নির্বাপিত করো................

মীরা জন্মেছিলেন বৈশাখমাসের শুক্লা তৃতীয়া তিথিতে সূর্য্যদেব তখন মেষরাশিতে অবস্থান করছেন তাই সূর্য্যের নামানুসারে সদ্যোজাত কন্যার নামকরণ করা হয় 'মিহিরা', মিহিরা থেকেই অপভ্রংশে মীরা মীরাবাঈ যখন জন্মগ্রহণ করেন তখন দিল্লীর সিংহাসনে সিকন্দর লোদীর রাজত্বকাল কয়েকবছর পরেই ইব্রাহিম লোদীকে পানিপথের প্রথম যুদ্ধে পরাজিত করে বাবর দিল্লীর সিংহাসনে বসেন৷ ইতিহাসের রঙ্গভূমিতে মুঘলদের সেই প্রথম পদসঞ্চার! মহারাণা সংগ্রামসিংহ(মীরাবাঈয়ের শ্বশুরমশাই) তখন স্বপ্ন দেখছেন ভারতে পুনরায় হিন্দু সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার তাঁর স্বপ্ন যদি সফল হতো, তাহলে মহারাণা সংগ্রামসিংহের পুত্র যুবরাজ ভোজরাজ ভারতের সিংহাসনে বসতেন এবং মহাসাধিকা মীরা হতেন ভারতের পট্টমহিষী

মীরার নিত্যসেবিত কৃষ্ণ বিগ্রহ সম্পর্কে জানা যায় যে, মহারাণা সংগ্রামসিংহের মাতাঠাকুরাণী রতনকুমারী দেবী একবার কাশী যান সেখানে মহাযোগী রৈদাস বা রুইদাসজী' সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ ঘটে তিনি রুইদাসজী' কাছে দীক্ষা গ্রহণ করেন এবং গুরুদক্ষিণা বাবদ নিজের আবাল্য উপাসিত গিরিধারীলালের বিগ্রহ গুরুদেব'কে দান করেন এর কয়েকবছর পরে রুইদাসজী একবার পুষ্কর যাত্রার পথে রাঠোর সর্দার রতনসিংহ গৃহে অতিথি ' মীরাবাঈ তখন শিশু, বয়স মাত্র পাঁচবছর গিরিধারীজী' সুন্দর বিগ্রহটি দেখে মীরা আব্দার করে বসেন যে, সেই মূর্তিটি তাঁর চাই! রুইদাসজী প্রথমে তা দিতে চাননি কিন্তু, সেখানে থাকাকালীন এক গভীর রাত্রে অপূর্ব বংশীধ্বনি শুনে তাঁর ঘুম ভেঙে যায় সদ্য নিদ্রাচ্যুত চোখে যারপরনাই ভাববিহ্বল নজরে দেখেন সম্মুখে প্রকট গিরিধারী আদেশ করছেন, "এই বিগ্রহ মীরাকে দান করে যা" প্রভুর আদেশ শিরোধার্য্য করে বিদায়কালে রুইদাসজী গিরিধারী বিগ্রহটি মীরাকে সমর্পণ করে যান৷
অর্থাৎ, মীরার দিদিশাশুড়ি(শ্বশুরমশাইয়ের মাতা)- উপাস্য দেবমূর্তি চিতোর থেকে কাশী ভ্রমণ করে মাড়োয়ারের পথ ধরে, মীরার মাধ্যমেই পুনরায় চিতোরে প্রত্যাবর্তন করেন!
অনেক গ্রন্থকার মীরাকে রাণা কুম্ভের স্ত্রী বলে বর্ণনা করেছেন এটি মারাত্মক ভুল তথ্য তেমনই মীরার শেষবয়সে বৃন্দাবন বাসের যে গালগল্প প্রচলিত তা' সম্পূর্ণ অমূলক মীরা ছিলেন সদ্গুরু মহাত্মা গুরু নানকের সমসাময়িক মুঘল সম্রাট তরুন আকবরের সঙ্গে যখন তাঁর সাক্ষাৎ হয়, তখন তিনি শতোর্দ্ধ বৃদ্ধা সমস্ত তীর্থ পরিক্রমান্তে মীরাবাঈ তখন পরিচয় গোপন করে, বান্ধবগড়ের বাঘেলা রাজা রামচন্দ্রের রাজপ্রাসাদে বাস করছিলেন
শিশুকালে গিরিধারীলালকে পাওয়ার পর থেকেই ইষ্টসেবাই হয়ে ওঠে মীরা' ধ্যানজ্ঞান গিরিধারীর সেবাপূজা করতে করতেই তাঁর কণ্ঠে স্বতঃই উৎসারিত হতে থাকে বিচিত্র সব গান যা সঙ্গীত জগতে তাঁর অভিনব সৃষ্টি মল্লার তীব্র সুরার মতো মাদকতা সিক্ত এই ভক্তি রাগাশ্রিত গান শুধুমাত্র আত্মবিনোদন নয়, প্রীতম প্রিয়তমের উপর জোড়-খাটানো আব্দার! প্রতিটি গানের প্রতি ছত্রে ছত্রে মীরার একটি আবেদনই যেন ঘুরেফিরে এসেছে, "মায়িরী, মায়িরী, ম্যায় তো গোবিন্দ্ লীনো মৌল.." অর্থাৎ, মা'গো, আমি তো গোবিন্দ'কে কিনে নিয়েছি
মীরা' ধ্যানদৃষ্টিতে যা প্রকাশিত হয়েছে, তা' তাঁর সঙ্গীতের প্রতিটি ছত্রে প্রস্ফুটিত তা সে, ইষ্টের সঙ্গে মিলনের আনন্দেই হোক বা বিরহের অশ্রুসিক্ত বিনিদ্র নিশিযাপনের ব্যথায়!

"বিরহিনী বৈঠী জাগু
জগৎ শোয়রে আনি
তারা গিন্ গিন্ রৈন বিহানী।।
হারে মেরা জনম-মরণকে সাথী
থানেঁ নহীঁ বিসরু দিন রাতি
হে-রী ম্যঁয়তো দরদ দিওয়ানী
মেরে দরদ জানেঁ কোয়
মীরা দাসী জনম জনম কী,
পড়ি তুম্হারে পায়।।"
অর্থাৎ, সারা জগৎ ঘুমিয়ে আছে, একা আমি জেগে বসে আছি বিরহিনী আকাশের তারা গুণে গুণে আমার সময় কাটছে ওগো আমার জীবন-মরণের সাথী, দিনেরাতে বারেকের তরেও তোমাকে ভুলতে পারছি না! তোমার জন্মজন্মান্তরের এই দাসী তোমার পায়ে পড়ে আর্তি জানাচ্ছি, আমার দুঃখ বোঝার মতো একজনকে অন্ততঃ অনুভূতি দান করো

সমাপ্ত

No comments:

Post a Comment