ঐতিহ্যের
ইতিহাসপর্বঃ
আজ প্রকাশিত হল
দ্বারিকানাথ দত্তের শিবদুর্গাপুজোর ইতিহাস। লিখলেন
বনেদীয়ানা পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ সদস্যা শ্রীমতী দেবযানী
বসু মহাশয়া। চলুন
দেখা যাক সেই পুজোর
ইতিহাস।
আভিজাত্যে
দত্তবাড়িঃ- শিবদুর্গাপূজা
আনুমানিক ১১৫০বছর আগে ভারতের ধর্মক্ষেত্রে
প্লাবন ঘটেছিল বৌদ্ধধর্মের।
পাল বংশের শাসনকালেও বাংলাদেশে
বৌদ্ধধর্ম প্রতিষ্ঠিত হয়। এই
সময় অধুনা বাংলাদেশের সুবর্ণগ্রাম
অঞ্চলে সুবর্ণবণিকদের খ্যাতি সারা ভারতে
ছড়িয়ে পড়েছিল। পাল
পরবর্তী সেন যুগে বল্লাল
সেন ব্রাহ্মণ্যধর্মকে প্রাধান্য দিতে থাকায় বৌদ্ধধর্মের
প্রভাব অনেকটাই ক্ষুণ্য হয়ে পুনরায় হিন্দু
দেবদেবীর আরাধনা হতে থাকে। এই
সময় কিছু সুবর্ণবণিক্ পরিবার
সুবর্ণগ্রাম ত্যাগ করে বর্ধমানের
কাছে কর্জনা নগরীতে এসে
বাস করতে থাকেন।
এদের মধ্যে ছিলেন শূলপাণি
দত্ত ও তাঁর পরিবার। এই
বংশেরই কৃতী পুরুষ দ্বারিকানাথ
দত্ত সততা ও নিষ্ঠা
দিয়ে বিশাল জমিদারির পত্তন
করেন। হয়ে
ওঠেন শহরে একডাকে চেনা
"ধনকুবের"। ঠনঠনিয়ার
কালিমন্দিরের উল্টোদিকেই তিনি নির্মাণ করেন
বিশাল অট্টালিকা। বেশ
কয়েক মহিলা ভবন, মাঝে
বিশাল অঙ্গন, চকমেলানো শ্বেতপাথরের
বহু খিলানের ঠাকুরদালান। ছোটোবেলা
থেকেই তাঁর স্বপ্ন ছিল
নিজ বাড়ির দালানে আবাহন
করবেন মা দুর্গাকে।
প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর বৈষ্ণবমনোভাবাপন্ন
হয়েও দ্বারিকানাথের মন শক্তিপুজো করার
জন্য উদ্বেল হয়ে ওঠে। কিন্তু
তার বৈষ্ণবমন মহাশক্তির অস্ত্রধারণী সিংহবাহিনী, যুদ্ধরতা রূপ মেনে নেয়নি। ঐশী
শক্তির বিগ্রহ নয়, মায়ের
কোমল রূপই ছিল তার
কাঙ্ক্ষিত। একদিন
রাত্রে তিনি স্বপ্ন দেখেন
মায়ের নয়নভুলানো এক রূপ-শিবের
কোলে হাস্যরতা মা দুর্গা।
প্রকৃতপক্ষে বঙ্গজননীর অঙ্গে শরতের প্রশান্ত
রূপ, শিউলির সুগন্ধ আর
মাঠে কচি ধানের হিল্লোলকে
তিনি ধরতে চেয়েছেন তাঁর
মূর্তিতে। সেই
শুরু। ১৮৫৫
সালে দ্বারিকানাথ বিশাল জাঁকজমক করে
পুজো শুরু করেন তাঁর
বাড়িতে। এ
বছর ১৬৪ বছরে পদার্পন
করতে চলেছে ঐতিহ্যমণ্ডিত এই
পুজো।
দত্তবাড়ির পুজোয় কিছু নিজেস্ব
বৈশিষ্ঠ্য আছে। সবচেয়ে
বড় বৈশিষ্ট্য হল শিবদুর্গা মূর্তি। এক
চালচিত্রের অনিন্দ্যসুন্দর প্রতিমা। দেবাদিদেব
শিব ষাঁড়ের ওপর বসে
আছেন। তার
বাম পায়ের ওপর দেবী
অধিষ্ঠিতা। দেবীর
ডান পা দোদুল্যমান, বাম
পা ডান উরুর ওপর
রক্ষিত। দুপাশে
থাকেন তার পুত্রকন্যারা।
এখানে তিনি বাংলার ঘরের
মেয়ে, বৎসরান্তে একবার পিতৃগৃহে আসা
সপরিবার বাঙালি বধূ।
প্রতিটি মূর্তি সোনারুপোর অলংকারে
সাজানো। মাথায়
সোনার মুকুট, হাতে চাঁদমালা,
শিবের সোনার ডমরু অর্ধচন্দ্র
ইত্যাদি।
দত্তবাড়ির শিবদুর্গা পুজো প্রকৃতপক্ষে দশদিনের। মহালয়ার
দিন থেকে শুরু হয়
নানা আচার অনুষ্ঠান।
প্রতিপদে বোধন, মহাষ্টমীর সন্ধ্যায়
কল্পারম্ভ। সম্পূর্ণ
বিশুদ্ধ বৈষ্ণবাচারে পুজো এগিয়ে চলে। শাক্তমতে
দেবী দুর্গা এখানে দ্বিভূজা। শৈবমত
মেনে তিনি শিবের কোলে
আসীনা। পুজো
হয় শাস্ত্রীয় বৈষ্ণব মন্ত্রে।
হিন্দুধর্মের মূল তিনটি শাখা-
শাক্ত, শৈব ও বৈষ্ণব। তিনটি
বিপরীতমুখী ধারার অপরূপ সমন্বয়। মহাষ্টমীর
দিন ধুনোপোড়া অনুষ্ঠান। এখানে
কুমারী ও সধবা পুজো
হয় নবমীতে। দশমীতে
কাঁধে করে অগণিত মানুষের
সুশৃঙ্খল, ভাব-গম্ভীর শোভাযাত্রা
সহকারে শিবদুর্গা মূর্তি নিরঞ্জিত হয়
গঙ্গায়।
ঠনঠনিয়ার দত্তবাড়ির পুজো শুরু হওয়ার
সময় থেকেই কলকাতার মানুষের
কাছে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ছিল এটি।
শুধু পুজোর শুদ্ধাচারের কথা
নয়, পুজো উপলক্ষে এ
বাড়ির নানা অনুষ্ঠানের কথাও
মানুষের মুখে মুখে ফিরত। বিখ্যাত
পত্রিকা 'সংবাদ প্রভাকর' থেকে
জানা যায়, দ্বারিকানাথের গৃহে
দুর্গাপুজোয় সাহেব মেমরা নিমন্ত্রিত
হয়ে আসতেন। বসত
বাঈনাচের আসর, থাকত ঢালাও
খাদ্য পানীয়ের আয়োজন। দ্বারিকানাথের
সময়কার জলুস আজ ম্লান,
তবে বনেদিয়ানা এখনও ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে
আছর এ পুজোর সর্বাঙ্গে।
তথ্যসূত্র
ও চিত্রেঃ- শ্রীমতী দেবযানী বসু(সাংবাদিক)
No comments:
Post a Comment