Thursday, July 25, 2019

আভিজাত্যে বনেদীবাড়িঃ- খড়দহের নিত্যানন্দ প্রভু প্রতিষ্ঠিত দুর্গাপুজো


ঐতিহ্যের ইতিহাসপর্বঃ
আজ প্রকাশিত হল খড়দহে নিত্যানন্দ প্রভু প্রতিষ্ঠিত প্রাচীন সেই দুর্গাপুজোর ইতিহাস লিখলেন বনেদীয়ানা পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য শ্রীমান্ শুভদীপ রায় চৌধুরী চলুন দেখা যাক সেই পুজোর ইতিহাস

 'আইলেন প্রভু খড়দহ গ্রামে
পুরন্দর পণ্ডিতের দবালয়ের স্থানে।।"(চৈতন্যচরিতামৃত)
সময় ১৪৫২ শকাব্দের আগে প্রভু নিত্যানন্দ খড়দহে এসে পুরন্দরের দেওয়া ২৬বিঘা জমিতে বসবাস শুরু করলেন আজকে যা "কুঞ্জবাটি" নামে পরিচিত তিনি মানব সমাজকে প্রেমভক্তি রসে উজ্জীবিত করেন আনুমানিক ১৪৫২ শকাব্দে অর্থাৎ ১৫৩০ সালে প্রভু নিত্যানন্দ, শ্রীপাট খড়দহে নিজ বাসভবনে দুর্গাপুজোর আয়োজন করেন সেই হিসাবে এবছর ৪৮৯ বছরে পদার্পন করবে এই ঐতিহ্যবাহী দুর্গাপুজো
 সময়ের হাত ধরেই নিত্যানন্দ প্রভুর পরিবার প্রসারিত হতে থাকে এবং বিভিন্ন পরিবারে বিভক্ত হয় যেমন- কিশোর পরিবার, বিহারি পরিবার, মাধব পরিবার, লাল পরিবার এই সমস্ত পরিবারের হাত ধরে দুর্গাপুজোর ধারাও চলতে থাকে নিত্যানন্দ প্রভুর পুত্র বীরভদ্র তৎকালীন গৌড়ের নবাব সুলেমান খাঁর কাছ থেকে একটি কষ্টিপাথর আনেন সেই কষ্টিপাথর দিয়ে তিনি শ্যামসুন্দরের মূর্তি তৈরি করান মূর্তি তৈরি করেন নয়ন ভাস্কর সেই মূর্তিই আজ তাঁদের সমস্ত পরিবারের গৃহদেবতা
 এপ্রসঙ্গে বলাবাহুল্য যে একটি কাহিনী প্রচলিত আছে, যা আজও লোকমুখে শোনা যায়
 বীরভদ্র, সুলেমান খাঁর কাছ থেকে যে কষ্টিপাথর আনেন, সেই পাথর থেকে তিনটি মূর্তি তৈরি করা হয় মূর্তি তিনটি যথাক্রমে খড়দহের শ্যামসুন্দর, শ্রীরামপুরের বল্লভজি সাইবোনার নন্দদুলাল কথিত মত অনুযায়ী মাঘি পূর্ণিমার দিন শ্যামের এই তিনরূপ দর্শনে পুণ্যলাভ অবশ্যম্ভাবী
 নিত্যানন্দ প্রভুর সপ্তম পুরুষ মদনমোহন মদনমোহনের চারপুত্র যথাক্রমে- জগমোহন, গৌরমোহন, ভুবনমোহন মথুরামোহন এঁরা আজ বড় বাড়ি, মেজ বাড়ি, সেজ বাড়ি ছোটো বাড়ি বলে পরিচিত
 এই মোহন পরিবারই নিত্যানন্দ প্রভু প্রতিষ্ঠিত মাতৃপূজার অনুরূপে বিশেষ ঘটা করে কাত্যায়নী দুর্গাপুজোর ধারাবাহিকতা বজায় রেখে চলেছে এত প্রাচীন পুজোর ইতিহাস লিপিবদ্ধ করতে পেরে আমরা ধন্য
 প্রভু নিত্যানন্দের প্রতিষ্ঠিত কাত্যায়নী দুর্গাপজোর বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য আছে যা অন্য পুজোর থেকে আলাদা এক চালায় প্রতিষ্ঠিত পুরোপুরি শোলার কারুকার্য খচিত অলংকারে শোভিত দশমহাবিদ্যার ষষ্ঠরূপ কাত্যায়নী এই রূপে দুর্গার দুইপাশে দেবী লক্ষ্মী সরস্বতীর জায়গায় এখানে বিরাজমান দুই সখী জয়া বিজয়া প্রভু নিত্যানন্দ বিশ্বাস করতেন কাত্যায়নীর পুজো করলে গৌরকে পাওয়া যায় আর গৌরের সাথে সাদৃশ্য রাখতে এখানে দুর্গার পাশে তার দুই সখীকে রাখার সিদ্ধান্ত নেন তবে কার্তিক গনেশ অপরিবর্তিত দেবীর বাহন সিংহ এখানে ঘোটক
 এই নিত্যানন্দ প্রভুর সপ্তমপুরুষ মদনমোহনের মেজো ছেলে ভুবনমোহনের বংশধর হল মেজ বাড়ি এই মেজ বাড়ির গৃহদেবতা গোপীনাথ বাড়ির উল্টোদিকেই গোপীনাথ মন্দির উল্টোরথের দিন গোপীনাথ মন্দিরে হয় দেবীর কাঠামোপুজো মেজো বাড়ির পুজোর রীতি অনুযায়ী চণ্ডী কৃষ্ণানবমী তিথিতে কুলদেবতা শ্যামসুন্দরের মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হয় সেই দিন থেকে শুরু হয় পুজো কৃষ্ণানবমী থেকে শুক্লা নবমী পর্যন্ত এই ১৫দিন চলে দুর্গাপুজোর অনুষ্ঠান প্রতিপদের দিন শ্যামসুন্দরের মন্দির থেকে চণ্ডী নিয়ে আসা হয় ষষ্ঠীর দিন সন্ধ্যায় বোধন শুরু হওয়ার পর দেবীকে সিংহাসনে তোলা হয়

 সপ্তমীর দিন সকালে বাড়ির সদস্যরা সকলে মিলে কলাবউকে গঙ্গায় শ্যামের ঘাটে নিয়ে যান ফিরে এসে নিত্যানন্দ প্রভুর রীতি মেনে কলাবউকে থান কাপর পড়ানো হয় কথিত আছে, প্রভু নিত্যানন্দ যখন পুজোর আয়োজন করছেন, তখন এক মহিলা তাঁকে একটি থান কাপড় দিয়ে যান প্রভু তখন সেই কাপড়টি কলাবউকে পরিয়ে দেন এবং সধবার চিহ্ন স্বরূপ তিনি সেই থান কাপড়ের ওপর সিঁদূরের রেখা টেনে দেন
এই পরিবারে পুজো হয় সম্পূর্ণ বৈষ্ণব আচারে এই পুজোয় কোন প্রাণ বলিদান করা হয় না অশুভ শক্তিকে দূরে সরিয়ে মায়ের কাছে যাতে কোন বিঘ্ন না আসে তারজন্য মন্ত্রের সাহায্যে মাসকলাই বলি দেওয়ার প্রথা আছে এই সময় পরিবারের সবাই একত্রিত হয়, মায়ের আরাধনা করেন প্রাচীন রীতি মেনেই এই পুজোর সময় মায়ের প্রসাদ সকলের জন্য বরাদ্দ থাকে এছাড়া বাড়ির সকলের জন্য অন্ন, শুক্তো, মুগ ঘন্ট, খিচুড়ি, বেগুনি, ডাল, পোস্ত, চচ্চড়ি, পুষ্পান্ন, ধোকা, ছানা কালিয়া, চাটনি, পরমান্ন, মিষ্ঠান্ন, লাউঘন্ট ইত্যাদি তৈরি হয়
 বিজয়া দশমীর দিন পরিবারের সকলে সিঁদুর খেলার পর সকলে মিলে প্রতিমা নিরঞ্জনের শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করেন আগে দেবীকে জোড়া নৌকায় তুলে গঙ্গাবক্ষে ঘরিয়ে তারপর বিসর্জন করা হয় বর্তমানে তা হয় না বিসর্জনের পর পরিবারের সকলে শ্যামসুন্দরের মন্দিরে আসেন সেখানের পুরোহিতরা সকলের মাথায় রাধেশ্যামের পরিহিত কৌপিনের টুকরো বেঁধে দেন এই প্রথাকেই প্রভু নিত্যানন্দ মিলনের প্রতীক হিসাবে দেখিয়ে গিয়েছিলেন
এককথায় ঐতিহ্য ধারাবাহিকতায় বজায় চলছে খড়দহের এই প্রাচীন পুজো ইতিহাস যেন কথা বলে
তথ্যসূত্র সংগ্রহেঃ শ্রীমান্ শুভদীপ রায় চৌধুরী
চিত্রঋণঃ- শ্রীমতী নন্দিনী বসাক


No comments:

Post a Comment