Saturday, July 20, 2019

কৃষ্ণনগর রাজবাড়িঃ- ঐতিহ্যপূর্ণ ও ঐতিহাসিক


ঐতিহ্যের ইতিহাসপর্বঃ
আজ প্রকাশিত হল কৃষ্ণনগর রাজ পরিবারের দুর্গাপুজোর ইতিহাস লিপিবদ্ধ করলেন পরিবারের সদস্য শ্রীমান্ শুভদীপ রায় চৌধুরী তথ্যসূত্র শ্রী নবকুমার ভট্টাচার্য্যের লিখিত "দুর্গা দুর্গোৎসব"

 কৃষ্ণনগর রাজবাড়িঃ- ঐতিহ্যপূর্ণ ঐতিহাসিক
এককালে দুর্গাপুজো ছিল কেবলমাত্র জমিদারবাড়ি রাজবাড়ির পুজো পুজোর বহু নিয়ম, উপকরণ, নিষ্ঠা, লোকবল, অর্থবল সব নিয়েই পুজো হত ঠাকুরদালানে, এখনও হয় সেই ঐতিহ্যমণ্ডিত ঠাকুরদালানে দেবীর আরাধনা তারপর দুর্গাপুজো বাংলার সার্বজনীন উৎসবের রূপ নিয়েছে বহুবছর কেটে গেছে জানা যায়, বাংলার তাহিরপুরের রাজা কংসনারায়ণের রাজবাড়িতেই দেবী দুর্গার পুজো মহাসমারহে প্রথম শুরু হয়েছিল দুর্গাপুজোকে জাতীয় উৎসবের রূপ দিতে রাজা কংসনারায়ণ থেকে পরবর্তীকালে বিভিন্ন রাজ পরিবারের ভূমিকা বিরাট কলকাতার প্রথম পুজো শুরু করেন সাবর্ণ গোত্রীয় লক্ষ্মীকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়, প্রথম স্বপরিবারে দেবীর আরাধনা তিনিই শুরু করেছিলেন
 অসময়ের পুজো অকালবোধন ঠিক সেই সময় রাজা-জমিদারদের ঘরে ঘরে বোধনের ঢাক ত্রেতাযুগে রামচন্দ্র লঙ্কাযাত্রার আগে অকালবোধন পুজো করে যুদ্ধজয় করেছিলেন তাঁর দুর্ভাগ্যও কেটেছিল তাই সেকালের জমিদার রাজারা শুরু করলেন শরৎকালে দেবীর আরাধনা



 বাংলার সর্বত্রই দুর্গাপুজো হয় শাস্ত্রবিধি নিয়ম অনুসারে সাধারণত বৃহন্নাদিকেশ্বর পুরাণ, কালিকাপুরাণ আর দেবীপুরাণ অনুযায়ী পুজো হয়, এছাড়া সাবর্ণদের বাড়িতে দুর্গাভক্তিতরঙ্গিণী মতেও পুজো হয় তবে বেশিরভাগ রাজপরিবারে বৃহন্নাদিকেশ্বর পুরাণ অনুযায়ী পুজো হয়
দুর্গাপূজা হিন্দুদের প্রধান উৎসব, দেবীভক্তগণ ইহাকে অশ্বমেধ বলে থাকেন, দেবীপুরাণে শারদীয়া পূজায় লেখা আছে-
"অশ্বমেধমবাপ্নোতি ভক্তিতঃ সুরসত্তম
মহানবম্যাং পূজেয়ং সর্ব্বকামপ্রদায়িকা।।"
ভক্তিপূর্বক পূজা করলে অশ্বমেধতুল্য ফল লাভ হয় আবার দেবীপুরাণে লেখা আছে-
"তুষ্টায়াং নৃপ! দুর্গায়াং নিমেষার্দ্ধেন যৎফলং
তদ্বক্তুং মহেশোহপি শক্তোবর্ষশতৈরপি।।"
অর্থাৎ দুর্গা সন্তুষ্ট হলে নিমেষার্দ্ধে যে ফল দান করতে পারেন, মহাদেব শতবর্ষেও তাহা বর্ণনা করতে পারেন না পুরাণাদি আলোচনা করলেও দেখা যায়, মহারাজ সুরথ সমাধি নামক বৈশ্য মৃন্ময়ী প্রতিমাতে পূজা করেছিলেন
"কালান্তরে পূজিতা সা সুরথেন মহাত্মনা
রাজ্ঞা মেধসশিষ্যেন মৃন্ময্যাঞ্চ সরিত্তটে।।"

এবার আলোচনায় কৃষ্ণনগরের রাজ পরিবারের দুর্গাপুজোর ইতিহাস দেখা যায় অতীতে কীভাবে এই পুজো শুরু হয়েছিল
 মহারাজা রুদ্র রায় ১৬৬৩ সালে দুর্গাপুজো শুরু করেছিলেন বলে দাবি করা হলেও কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির ১৭৫৭ সালের পর থেকেই দুর্গাপুজোর রমরমা শুরু হয়েছিল এই ধুমধাম আরাম্ভ করেছিলেন মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র পলাশির যুদ্ধক্ষেত্রে বাংলার স্বাধীন নবাব সিরাজের পরাজয়ে সবচেয়ে লাভবান হয়েছিলেন নদীয়া রাজ কৃষ্ণচন্দ্র কারণ আগে তাঁকে বার্ষিক খাজনা দিতে হত ১১লক্ষ টাকা, ক্লাইভের সৌজন্যে তা হয়ে গেল ৬লক্ষ টাকা এই যুদ্ধে সিরাজদ্দৌল্লা হেরে যাওয়ার ফলে কৃষ্ণচন্দ্র নিজেকে স্বাধীন হিন্দু রাজা হিসাবে ভাবতে শুরু করেছিলেন, আর হিন্দুরাও তাঁকে নিজেদের প্রতিনিধি মেনে নিয়েছিল ক্লাইভের জয়কে কৃষ্ণচন্দ্র নিজের জয় বলে পালন করলেন বিজয় উৎসব করে ব্যাপারে তাঁর সঙ্গে হাত মেলালেন কলকাতার শোভাবাজারের রাজা নবকৃষ্ণ দুজনেই ধুমধাম করে দুর্গাপুজো শুরু করলেন
 প্রায় ১১জন পুরোহিত মিলে ওই পুজো হয়েছিল ১০০১ টা পাঁঠাকে বলি দিয়েছিল পুজো উপলক্ষে রাজবাড়িতে বাঈজি নাচের ব্যবস্থাও করা হয়েছিল পুজোর আচার অনুষ্ঠানেও নদীয়া রাজবাড়িতে ইতিহাস আজও জীবন্ত এখনও এখানে হোম শুরু হয় দেবীপক্ষের তৃতীয়ায়, সেই হোম নির্বাপিত হয় নবমী শেষে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের আমল থেকেই সন্ধিপুজোর দেবীর পায়ে নিবেদন করা হয়ে আসছে ১০৮টি পদ্ম।। আগে দেওয়া হত নীলপদ্ম এখন দেওয়া হয় লালপদ্ম

তবে রাজবাড়ির পুজোয় এখন আর কামান দাগানো হয় না, বন্ধ হয়ে গেছে পশুবলিপ্রথাও তিনদশক আগেও দেবীকে গঙ্গামাটি দিয়ে গড়ে তোলা হত, এখন জলঙ্গির পাড়ের মাটি তুলে এনে দেবীকে গড়তে হয় বংশানুক্রমিক ভাবেই প্রতিমা তৈরির কাজ করে আসছেন কৃষ্ণনগর শহরের পালপাড়ার মৃৎশিল্পীরা দেবী যোদ্ধাবেশী ঘোটক মুখী সিংহের উপর আসীনা একাদশ শতাব্দীতে রাজা কংসনারায়ণ দেবীর যে রণংদেহী মূর্তির আরাধনা করতেন, কৃষ্ণচন্দ্রও সেই ভাবনায় অনুপ্রাণিত

 একচালচিত্রের পুত্রকন্যাসহ দেবীপ্রতিমার নাম "রাজরাজেশ্বরী" দশমীর পুজোর পর হয় "যাত্রামঙ্গল অনুষ্ঠান" আর হয় "শত্রুবধ" দশমীর বিসর্জনের পর বেল গাছের নীচে রাখা কাঁচা মাটির তৈরি একটি দস্যু মূর্তিকে তির ধনুক দিয়ে বধ করেন রাজ পরিবারের প্রবীন পুরুষ এখনও এই প্রথা বন্ধ হয়নি এখন আটটি ঢাক বাজে সিন্দূর খেলাও হয় রাজবাড়িতে
তথ্যঋণঃ শ্রী নবকুমার ভট্টাচার্য্যের "দুর্গা দুর্গোৎসব"
চিত্রঋণঃ শ্রীমান্ বিশ্বরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়, ABP Archives ও অন্যান্য





No comments:

Post a Comment